সুরজিৎ সুলেখাপুত্র

 সুরজিৎ সুলেখাপুত্র

সেস্টিনাঃসৃষ্টি আর নির্মাণের দ্বন্দ্ব

দু-এক টুকরো পুরনো ভাবনা

‘কবিতা কী’- এর উত্তর জীবনানন্দ তো বলেই দিয়েছেন, কবিতা অনেকরকম। কিন্তু ‘অনেকরকম’-এই কথাটা ঠিকঠাক কী অর্থে নেব আমরা? কবিতার ভাবনার দিক(অর্থাৎ বক্তব্য)এবং বলবার ধরণ(অর্থাৎ আঙ্গিক)- দুদিক দিয়েই কথাটা মেনে নেওয়া চলে তো? নাকি কবিতার বলার কথায় তেমন কোনও বৈচিত্র্য নেই,- অনেকদিনের পুরনো তিন-চারখানা বিষয় নিয়েই কবিদের যাবতীয় উচ্ছাস, বদলে যায় শুধু বলার ভঙ্গী! তাহলে তো কবিতার ইতিহাস দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র আঙ্গিকেরই ইতিহাস এবং শুধু কবিতা কেন, বোধ হয় গান ছবি ভাস্কর্য প্রভৃতি শিল্প সৃষ্টির সমস্ত শাখাতেই এই কথাটা সত্যি।

আঙ্গিকের দিকে তাকালে, বাস্তবিক, কবিতায় বৈচিত্র্যের এক বিরাট জগত আমাদের সামনে খুলে যায়। কেবল মাত্র বাংলা ভাষায় লেখা কবিতার ক্ষেত্রেও এই কথা মেনে নেওয়া চলে। যদি চর্যাপদের সন্ধ্যাভাষার পাশাপাশি হাংরি জেনারেশনের ক্যালিগ্রাম অথবা মাইকেল মধুদসূদনের সনেটের সাথে জয় গোস্বামীর মায়ের সামনে স্নান করতে লজ্জা নেই-এর টানা গদ্যরচনাগুলি সাজিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে এই আঙ্গিকের ব্যাপারটা বাংলা কবিতার সময়ের সাথে কত বিচিত্র চেহারা নিয়েছে তা কিছুটা পরিষ্কার হবে।

আসলে আঙ্গিকে অথবা কবিতার শরীর নিয়ে ভাবনা কবির পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। শব্দ, বাক্য, ছন্দ, মিল, অলংকার প্রভৃতি সবকিছু নিয়েই তো এই আঙ্গিক এবং এগুলোকে বাদ দিয়ে কবিতা রচনাই যে সম্ভব নয়। তাই জেনে অথবা না জেনে কবিরা আঙ্গিক নিয়ে ভাবতে বাধ্য হন। শঙ্খ ঘোষও কবিতাতেই বলে ফেলেন-“কিন্তু বলবে কোন ভাষায়?না, এই পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া কথা তোমার ঠোঁটে ধোরো না।” আসলে বলার নতুন ভঙ্গী খুঁজবার মধ্যেই আছে নিজস্বতা, আছে অতীতের পুনরাবর্তন থেকে মুক্তির রাস্তা। রবীন্দ্রনাথ ‘লিপিকায়’ পথ দেখিয়েছিলেন গল্প আর কবিতার পার্থক্য কিভাবে ঘুচিয়ে দেওয়া যায়, অরুণ মিত্র পরিণত বয়সে অন্ত্যমিলের খেলায় আর থাকতে চাননি, বড়জোর ছন্দটুকু মেনে নিয়েছিলেন। এমনিতেই ভাবের উপযুক্ত শব্দ ও ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না, তারপর যদি মিল ও গঠনের জটিলতায় খুঁজে পাওয়া একটা শব্দকেও বিসর্জন দিতে হয়, আর বদলে বেছে নিতে হয় অনুপযুক্ত একটা শব্দ- তাহলে আর লিখে লাভ কী? বন্যার স্রোতের মতো আবেগের টানে যেসব শব্দ আর বাক্য উঠে আসছে চেতনার গভীর থেকে তাদের সামনে মূর্তিমান বাঁধ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আঙ্গিকের কঠোরতা- এ যেন কখনো না হয়- এইই হল সব কবির মনের কথা।

কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত আবেগেই কি ভালো? সে যে কবিতার কত ক্ষতি করতে পারে, তা নজরুলের বেশ কিছু কবিতা পড়লেই কি বোঝা যায় না সহজে? অবশ্য প্রেরণায় যেসব স্রষ্টা বিশ্বাস করেন , তারা এই সমালোচনায় কান দেন না। আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশই তাদের কাছে শেষ কথা। অন্যদিকে আবার বহু কবি আছেন, যারা বন্ধনের ভিতরেই মুক্তি খুজতে চেয়েছেন। শেক্সপীয়র লিখেছেন দেড়শোর বেশী সনেট, কঠিনতর সব কাব্যছক খুঁজে বের করে অনবরত চর্চা করেছেন স্বয়ং কবিরাই, আবেগের সংযত প্রকাশেই তারা সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন।

ভাবনা থেকে দর্শনে

তাহলে সৃষ্টির মনের কথা কী দাঁড়াল? আঙ্গিকের প্রতি দ্বেষ? নাকি তার প্রতি এক রহস্যময় ও কষ্টকর আকর্ষণ? অন্য কথায়, আবেগ না সংযম- কোনটা কবিতা রচনার শেষ কথা? দুয়েরই এক সুষ্ঠু ভারসাম্য দরকার- এই নিরপেক্ষ অবস্থান উচ্চারণ করা সোজা হলেও প্রয়োগ করা যথেষ্ট কঠিন- ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। শিল্প দর্শনের অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখব,এই দুই পরস্পর বিপরীতের ভেতর যেন এক দেওয়া নেওয়ার খেলা চলছে। কোন এক যুগে শিল্পি – সাহিত্যিক- কবি- সঙ্গীত স্রষ্টাদের কাছে আবেগ প্রধান হয়ে উঠেছে, ঠিক তার পরেই দেখা যাচ্ছে সংযমের প্রতি সমর্থন।

একেবারে অতীতে গেলে দেখব, সংযম থেকেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিলো। পৃথিবীর সমস্ত্য কাব্য, নাটক, দর্শনের উৎপত্তি ও বিকাশ যে গ্রীক এবং তারপর রোমান সভ্যতায়, যেখানে সংযম ও নিয়মই ছিল সৃজনের শেষ কথা। প্রকৃতির যেকোনো সৌন্দর্যের পেছনে আছে গণিতের নির্ভুল হিসেব- এই ছিল পিথাগোরাসের অমর উপলব্ধি। ফুলের ছয়খানা পাপড়ি নির্দিষ্ট কোনে সজ্জিত হয়, সূর্যমুখী ফুলের মাঝখানে রয়েছে পাঁচশো বৃত্তের এক নিখুঁত হিসেব, ফাইবোনেচ্চি সংখ্যার নিয়মে গাছে গজায় পাতা। অতএব নাটক, কবিতা, ভাস্কর্য- সর্বত্র রয়েছে নিয়মের, পরিমানের এবং পরিণতির এক চরম নিয়ন্ত্রণ, সৃজনের সৌন্দর্য সবটাই নির্ভর করে তার উপর।

অন্ধকার যুগের পর রেনেসাঁ যুগের সৃষ্টিতে গ্রীক ও রোমান যুগের এই ক্লাসিক দর্শনের পুণর্জাগরণ দেখতে পাই। কিন্তু ১৪০০-১৬০০ সালের মধ্যবর্তী রেনেসাঁ পর্বের পর ইউরোপে দেখা দিল যে বারোক যুগ, তার মূল কথাই ছিল অতিরঞ্জন। বাড়িয়ে বলার মধ্যেই আছে সৌন্দর্য, নিজের যা মনে হচ্ছে- তার মধ্যেই আছে সত্য- এই কথাই বিশ্বাস করতে আরম্ভ করল মানুষ। আমি কীভাবে আমার কথা বলব, সেটা ঠিক করব আমিই, অন্য কেউ অথবা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা কোনও প্রথা আমার বলার ভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করবে- এই পরাধীনতার কোনও অর্থ নেই। সুন্দরের কোনও তৈরি করা একটাই সংজ্ঞা নেই, আমার যা সুন্দর মনে হচ্ছে- সুন্দর সেটাই। ১৬০০-১৭২৫ সাল পর্যন্ত চলল এই তথাকথিত নৈরাজ্য। এরপর আবার ফিরে এলো ক্লাসিকের যুগ, গণিতের কাছে মাথা নীচু করল মানুষ। ১৮০০ সালের পরে কিন্তু আবার নির্ধারিত সুন্দর পিছু হটল, শুরু হল রোমান্টিক যুগ, আবার জয় হল ব্যক্তিসত্যের, বিষ শতকেও ছিল রোমান্টিক যুগের প্রসার, তবে মাঝে মাঝেই একক কোন শিল্পীর কাজে অথবা গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ফিরে এসেছে ক্লাসিক, চলে গিয়েছে আবার।

আসলে এই লড়াই শেষ হওয়ার নয়, দুই পক্ষেই রয়েছে কিছু মূল্যবান বক্তব্য, হয়তো তা পরস্পরবিরোধী, কিন্তু দ্বান্দ্বিকতার সত্য তো এটাই। অতএব মত ও পথের এই যাওয়া আসা চলতেই থাকবে।

ক্লাসিজমের প্রাবল্যের সময় কবিতার জগতে আমরা দেখেছি, নানা বিচিত্র ধরনের সব কাব্য ছক। মাত্রা গণনায় বাঁধন, পংক্তি সংখ্যায় নির্দিষ্টতা, অন্ত্যমিলের জটিলতা- প্রভৃতি নানা পথে আবেগের উচ্ছ্বাসকে বেঁধে মারার নানারকম সুবন্দোবস্ত এইসব কবিতার ধরণগুলিতে উপস্থিত ছিল। তবে এইভাবে বললে শিল্পদর্শনটিকে প্রতিশোধমূলক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, আমরা খেয়াল রাখব, কাউকে অবদমন করা নয়, প্রকৃতির ভিতর নিহিত এক গভীর ও গাণিতিক সৌন্দর্য নিজের জীবনে, নিজের কাজে প্রতিফলিত করাই ছিল ক্লাসিক দর্শনের সারবত্তা। এর জন্য তো কষ্ট স্বীকার একটু করতেই হবে।

নানারকম কাব্যছকের মধ্যে প্রেত্রার্ক প্রবর্তিত এবং পরে আরও নানাজনের ভাবনায় সমৃদ্ধ সনেট আঙ্গিকের কথা আমরা প্রায় সকলেই জানি। এইরকমই একটি কাব্যছক সেষ্টিনা নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা।

সেষ্টিনা কাব্যছকের ইতিহাস

সেষ্টিনা(sestina),সেস্কটাইন(sextine),সেক্সটেইন(sextain) প্রভৃতি নামেও সেষ্টিনা(sestina)পরিচিত। দ্বাদশ শতকের চারণকবি আর্লা ড্যানিয়েল রচিত সেষ্টিনাটিই পৃথিবীতে প্রাচীনতম। কেউ কেউ তাকেই এই কাব্যছকের আবিষ্কর্তা বলেন, কেউ বলেন তাঁর আগে থেকেই এই ছক চালু ছিল। চারণকবিদের স্বতঃস্ফূর্ত ঐতিহ্যের মধ্যেই আমরা সেষ্টিনা ছকের মত জটিল একটি গঠন দেখতে পাই- এ থেকেই বোঝা যায় দ্বান্দ্বিক সত্যের মাহাত্ম্য। বৃহত্তর স্থানকালের প্রেক্ষাপটেই সবকিছুর প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারা যায়, নইলে আমরা নিজেদের সঙ্কীর্ণ ভাবনাচিন্তা ও পছন্দের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থেকে যাই। তেরো শতকে দান্তে ও প্রেত্রার্ক এই ছকে প্রচুর কবিতা লিখেছেন, তারপর ইতালি থেকে পনের শতকে এই ছক পৌঁছায় পর্তুগালে। ষোল শতকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সে। ১৬১৬ সালের পর বারোক যুগ পেরিয়ে প্রায় আড়াইশো বছর ইওরোপে আর কোনও সেষ্টিনা পাওয়া যায় নি। ১৮৭০ সালে ফ্রান্সে আবার রচিত হল এই ছক। ১৯৫৩ সালের আগে পরে অডেন, এজরা পাউন্ড, জন অ্যাশবেরি প্রমুখ বিখ্যাত কবিরা সেষ্টিনা লিখতে শুরু করেন। এই সময়কাল সেষ্টিনা যুগ নামে বিখ্যাত।

সনেটের মতোই সেষ্টিনা ছকেরও নানারকম বৈচিত্র্য যুগে যুগে সৃষ্টি হয়েছে।

সেষ্টিনার গঠন

ড্যানিয়েলের রচনা অনুসারে,সেষ্টিনা ঊনচল্লিশ পংক্তির কবিতা। ছয় পংক্তির ছয়টি স্তবকে ছত্রিশ পংক্তি, তারপর তিন পংক্তির একটি অর্ধ স্তবক। ছয় পংক্তির স্তবকগুলির নাম সিক্সেনস (sixens) ও তিন পংক্তির অর্ধ স্তবকটির নাম টার্সেট(tercet)। এর আরও নাম হল এনভয়(envoy) অথবা  টর্নাডা (tornada)। এই কবিতার নিয়ম হলঃ

১/সিক্সেনসগুলির প্রথম পংক্তি হবে সাত মাত্রার এবং বাকি পাঁচটি পংক্তি হবে দশ মাত্রার।

২/ প্রথম  সিক্সেনসটির ছয় পংক্তির শেষে যে ছয়টি শব্দ ব্যাবহার হবে তারাই ফিরে ফিরে আসবে পরের সিক্সেনসগুলিতে, অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে আমরা যেরকম ধ্বনিসাম্যযুক্ত অন্য শব্দ ব্যাবহার করি সেরকম নয়।

৩/

স্তবক I II III IV V VI
শব্দ
A 1(A) 6(F) 3(C) 5(E) 4(D) 2(B)
B 2(B) 1(A) 6(F) 3(C) 5(E) 4(D)
C 3(C) 5(E) 4(D) 2(B) 1(A) 6(F)
D 4(D) 2(B) 1(A) 6F() 3(C) 5(E)
E 5(E) 4(D) 2(B) 1(A) 6(F) 3(C)
F 6(F) 3(C) 5(E) 4(D) 2(B) 1(A)

2017-14-3--13-19-05

 

ড্যানিয়েলের মিলের এই ছককে বলেছিলেন ক্লেভিস্যাট( অর্থাৎ, ইন্টারলক বা পরস্পর বন্ধক)। ছকের নীচের দিকে প্রথম স্তবক থেকে দ্বিতীয় স্তবকে মিলের ছক কীভাবে হবে, তা ঘড়ির কাঁটা অনুসারী তীর চিহ্ন দিয়ে দেখান হয়েছে। প্রথমে নেওয়া হবে ষষ্ঠ পংক্তির শেষ শব্দটি, সেটি দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম পংক্তির শেষে বসবে। এবার প্রথম পংক্তির শেষ শব্দ, সেটি যাবে দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় পংক্তিতে। এরপর পঞ্চম পংক্তির শেষ শব্দ ও দ্বিতীয় পংক্তির শেষ শব্দ ও দ্বিতীয় পংক্তির শেষ শব্দ এই শব্দ জুড়ি বসবে দ্বিতীয় স্তবকের তৃতীয় ও চতুর্থ পংক্তিতে। শেষে নেওয়া হবে চতুর্থ ও তৃতীয় পংক্তির শেষ শব্দ, এই জোড়াটি বসবে দ্বিতীয় স্তবকের পঞ্চম ও ষষ্ঠ পংক্তিতে। ফলে প্রথম স্তবকে যা ছিল 1(A),2(B),3(C),4(D),5(E),6(F), দ্বিতীয় স্তবকে তা হয়ে গেলো

6(F),1(A),5(E),2(B),4(D),3(C)।

এবার নেওয়া হবে দ্বিতীয় স্তবকের ছক। এতে প্রযুক্ত হবে ঐ ঘড়ির কাঁটা অনুসারী পথ। তাঁর সাহায্যে তৈরি হবে তৃতীয় স্তবক। এইভাবে ষষ্ঠ স্তবক পর্যন্ত চলবে।

তিন পংক্তির টার্সেটের জন্য দুটি বিকল্প। হয় 5(E),3(C),1(A)  অথবা 2(B),4(D),6(F)- এই হিসাবে থাকবে পংক্তি শেষের শব্দ। তবে যে বিকল্পটিই নেওয়া হোক, তাতে তিনটি পংক্তির ভিতরে কোথাও থাকবে ব্যবহার না হওয়া ত্রয়ী। অর্থাৎ যদি ৫-৩-১ পংক্তির শেষে যায়, তাহলে ভিতরে থাকবে ২,৪,৬। আর যদি ২-৪-৬ শেষে যায় তাহলে ভিতরে থাকবে ৫,৩,১, স্পেনীয় কবি সেটিনা এতেও আবার বৈচিত্র্য এনেছেন।

ছয়টি স্তবকে অন্ত্যমিলের অথবা অন্তশব্দের যে পুনরাবর্তনের ছন্দ দেখা গেল, তাকে বলে রেট্রোগ্রেসিভ ব্রুসিয়াটা। একে লেক্সিয়াল পুনরাবৃত্তিও বলা হয়।

বৈচিত্র্য

অনেক কবিই আছেন যারা ডবল সেষ্টিনা লিখেছেন। এদের সেষ্টিনা পঁচাত্তর লাইনের (১২x৬)+৩, অথবা একশো পঞ্চাশ লাইনের (১২x১২)+৬। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে টার্সেটটিও হল ডবল টার্সেট। আর এসব ক্ষেত্রে ছয় পংক্তির ছয়টি স্তবকের স্থানে বারো পংক্তির ছয়টি বা বারোটি স্তবক ব্যাবহার হবে।

অন্যদিকে অর্ধেক সেষ্টিনাও রচিত হয়েছে অনেক। এটি প্রথম লিখেছিলেন মারি পন্সট। এর নাম ট্রিটিনা। এটি দশ পংক্তির কবিতা। তিন পংক্তির তিনটি স্তবক এবং শেষে একটিই পংক্তি। এর শব্দ পুনরাবৃত্তির ছকটি হল(১.২.৩),(৩,১,২),(২,৩,১)এবং (১,২,৩)। শেষে এক পংক্তির ভিতরে আগের তিন পংক্তির তিনটি শব্দই ঢুকে থাকবে। অন্তে থাকবে তৃতীয় পংক্তির শেষ শব্দ।

৬-১,৫-২,৪-৩- এর এই জটিল ছন্দে চারণকবিরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গান রচনা করতেন আর গাইতেন, প্রধান বিষয় ছিল নায়ক- নায়িকার প্রেম। এছাড়া অন্য সব রকম বিষয়ের উপরেই সেষ্টিনা পাওয়া যায়। এই একুশ শতকেও অনেকেই তেড়েফুঁড়ে সেষ্টিনা লিখছেন।

তাঁরা কী বলেন……

সাহিত্য সমালোচকরা, যেমন হয়, সেষ্টিনা বিষয়ে দুই দলে বিভক্ত। কবিরাও। একদল মনে করেন এ হল কৃত্রিম, আড়ষ্, জটিল, ও অর্থহীন এক নির্মাণ। অন্যদলের মতে, টানটান উত্তেজনা ও পরমুহূর্তে তাঁর মুক্তির এক ভাবগত সাযুজ্য এই গঠনের মধ্যে লুকোনো আছে, যার সুযোগ কবি বিনা আয়াসে নিতে পারেন। তাই বিষয়বস্তুকে নাটকীয় ভাবে উপস্থিত করতে, ভিতরে ভিতরে গোপনে দোলা লাগাতে এই ছকের জুড়ি নেই। তাঁর ওপর সেমানটি্ক্স বা শব্দার্থ গত বৈচিত্র্য রচনার সুযোগও এখানে কবি পেয়ে যান। যেহেতু একই শব্দ ঘুরে ফিরে বিভিন্ন স্তবকে আসতে থাকবে, সেহেতু যমক অলংকার এক্ষেত্রে খুব কাজে দেবে। একই শব্দ কিন্তু দুটি বা তিনটি বা তাঁর বেশী ভিন্ন অর্থে ভিন্ন ভিন্ন স্তবকে ব্যাবহার হলে কবিতা খুবই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। বাংলায় এরকম শব্দ হল তীর অথবা কুল, যার বিভিন্ন অর্থ আছে। এইশব শব্দ ব্যবহার করে(অথবা না করে) গাণিতিকভাবে সম্পূর্ণ এই সৌন্দর্যটির নেশায় কেউ পড়েন তাহলে এই লেখা সার্থক হবে।

শেষ কথা

বাংলা ভাষায় রচিত সেষ্টিনার সন্ধান আমি পাইনি। অথচ একটি উদাহরন না হলে ত্বাত্তিক আলোচনা নুন বর্জিত খাদ্যের মতোই বিস্বাদ। অতএব একটু ভিন্নভাবে শেষের কবিতার সেই দুঃসাহসী কবি নিবারণ চক্রবর্তীর শরনাপন্ন হতে হল। তিনি ড্যানিয়েলের আদি আদর্শে যমক বর্জিত একটি সেষ্টিনা সাথে সাথে রচনা করে দিলেন। কেবল মাত্র রচনা পদ্ধতিটি বুঝবার স্বার্থে লেখাটি এখানে সংযুক্ত করা হল।

আলো- একটি সেষ্টিনা

 

১ আকাশে গভীর আলো(৭)

২জেগে ওঠে মধ্যরাত্রি জুড়ে।(১০)

৩ উৎস বুঝিনা তাঁর, শুধু জানি,(১০)

৪এই আলোটিকে পৃথিবীর পথে(১০)

৫যদি পাওয়া যেত প্রতিদিন রাত(১০)

৬তবে এই জীবনের বাকি সব কাজ(১০)

 

৬  সারা হত দ্রুত। কাজ(৭)

১  শেষ হয়ে গেলে যদি এই আলো(১০)

৫  ছিলনা জানতে পারি, সারারাত(১০)

২  শুধু অন্ধকার চরাচর জুড়ে(১০)

৪  যদি দেখি পৃথিবীরই পথে(১০)

৩  পাথর ছড়ানো, তবু ঠিক জানি(১০)

 

৩ এই শেষ নয়, এও জানি(৭)

৬ মানুষের জ্ঞান, প্রীতি,আচরন, কাজ(১০)

৪ ও কাজের স্মৃতি আজো সেই পথে,(১০)

১ পথের ধুলায় লেখা, তাতে আলো(১০)

২ আসে অনুভুতি থেকে, জুড়ে(১০)

৫ যায় অনায়াসে এদিবস ও রাত।(১০)

#

৫ সেই আলো খুলে দেয় রাত।(৭)

৩ খোলা সেই দ্বারের ওপাশে জানি(১০)

২ শুধু ছায়া, এ পৃথিবী জুড়ে(১০)

৬ সেই ছায়া খেলা করে, এইসব কাজ(১০)

১ ও কাজের অছিলা যত, আলো(১০)

৪নেভা আঁধারেই জীবনের পথে।(১০)

#

৪  জেগে থাক, অন্য পথে(৭)

৫  কিছু নেই, এই দিন অথবা এ রাত(১০)

১  এরকমই অন্ধকার, তাই আলো(১০)

৩  না- থাকা অথবা থাকা- জানি(১০)

৬  মূল্যহীন, মুছে দিয়ে যত কাজ(১০)

২  ব্যাথা বাজে বালিয়াড়ি জুড়ে(১০)

 

২  আজ সকল সময় জুড়ে(৭)

৪  দ্বন্দময় এই বোধ পৃথিবীর পথে(১০)

৬  কেবল ছড়িয়ে আসা, কোন কাজ(১০)

৫  পড়ে নেই, এখনো কতটা রাত(১০)

৩ বাকি-আমি তার সামান্যই জানি।(১০)

১ গান শেষ হয়ে নিভে গেছে আলো।(১০)

 

৫  মেধা জুড়ে আজ খেলা করে রাত(১০)

৩  পথে ও বিপথে তবু জানি(১০)

১  কাজ আছে, জ্বলে কি নেই ওই আলো? (১০)

One thought on “সুরজিৎ সুলেখাপুত্র

আপনার মন্তব্য এখানে রাখুন