রামচন্দ্র প্রামাণিক

রামচন্দ্র প্রামাণিক

 

কবিতা বনাম কবিতার প্রায়

 কোনো লেখক যখন তাঁর বইয়ের নাম রাখেন “কবিতার প্রায় ” তখন  বোঝা যায় তিনি লেখাগুলোকে কবিতা বলে দাবি করছেন না l বোঝা যায় যদিও তিনি এগুলোর কাব্যগুণ সম্বন্ধে সচেতনত, জানেন এগুলো হয়ে উঠেছে কবিতার মতো , এ-ও তিনি জানেন এরা কবিতা নয় l
বস্তুত এই স্বীকারোক্তির পেছনে যে সাহসিকতা রয়েছে তা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ l  কেননা কবিতার নামে আমরা হামেশাই অজস্র রচনার মুখোমুখি হই যারা , প্রথম পাঠেই বোঝা যায় , কবিতা নয় , বড় – জোর কবিতার মতো , ওই সাহসী লেখকের ( সন্তোষ কুমার ঘোষ ) ভাষায় ‘ কবিতার প্রায় ‘ ।
তাহলে সেই পুরানো প্রশ্ন আবার উঠে পড়ে , কোনটি কবিতা এবং কোনটি কবিতা নয় l  তার সঙ্গেই এস পড়ে , কোন ধরনের রচনা কবিতার মতো -কবিতা প্রায় – কিন্তু হয়ে উঠতে পারল না একটি স্বয়ং – সম্পূর্ণ শিল্প – প্রতিমা যাকে বলা যায় কবিতা এবং কেন – এই প্রশ্নও l
অনেকদিন আগে কৃত্তিবাসের এক সংখ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সতীর্থ আলোকরঞ্জনের কবিতা – আলোচনা প্রসঙ্গে সেই দুর্লভ আবেগের কথা তুলেছিলাম ‘ যার ছোঁয়ায় এক মুহূর্তে সাধারণ কথাতেও আনন্দধ্বনি আসে ‘l এই যে ‘ সাধারণ কথাতেও আনন্দধ্বনি ‘ এটি নিঃসন্দেহে মহৎ কবিতার একটি অপরিহার্য লক্ষণ ; এবং এই তত্ত্ব জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তখনকার তরুণ কবিদের খুব টেনেছিল, কারণ কবিতায় শেষাবধি কোনো তত্ত্ব বা দর্শনকে মাথা তুলে দাঁড়াতেই হবে এরকম এক অবসেসন দীর্ঘদিন যাবৎ গ্রাস করেছিল বাংলা কবিতার পাঠককে l এই অবসেসন-এরই ফলশ্রুতি ” চিত্রা “র ‘ দিনশেষে’ ( ‘ বেলা শেষ হয়ে এলো আঁধারিল ধরণী ‘) কিংবা “খেয়া “র ‘ কুয়ার ধারে ‘ (‘ তোমার কাছে চাইনি কিছু জানাইনি মোর নাম ‘) প্রভৃতির মতো মনকেমন – করা লাবণ্যময়ী কবিতায় তত্ত্ব খুঁজে বের করার অ্যাকাডেমিক প্রয়াস l  এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই নিছক ভাললাগা ,, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কে ঘিরেও , গুনগুনিয়ে উঠল কবিতায় l এবং সব প্রতিক্রিয়ার মতো  এখানেও পৌঁছুল, কালক্রমে , চরমে l
কিন্তু এর অন্তর্নিহিত বিপদটাকে আমরা তেমন ভাবে দেখিনি l  এই সাধারণ কথাতেও আনন্দধ্বনি , এই তুচ্ছ কথাও সুরে বেজে ওঠা – এ কি আমরা হামেশাই প্রত্যক্ষ করি না কবিতা – নিরপেক্ষ জীবনে , পথ – চলতি কথাবার্তায় , দৈনন্দিন উল্লাসে ও বিক্ষোভে ? হ্যাঁ বিক্ষোভেও – কেননা তা- ও আবেগজাত , সেখানেও এসে যায় সুর , অনভিপ্রেত হলেও l
আমাদের মধ্যে যারা শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছে গ্রামে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছে গ্রাম্য মানুষের ভাষা কি পরিমাণ উপমা – নির্ভর , তাদের কথার টানে কিভাবে এসে লাগে সুর , আবেগ কেমন স্পষ্ট মূর্তি পায় বাচনভঙ্গিতে – সব মিলিয়ে জা হয়ে ওঠে কবিতার মতো l আমরা যারা বেঁচে আছি শহরে , আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছি জীবিকার ক্লেশে , নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি ট্রামে বাসে কথ্য ভাষায় তির্যক শ্লেষ , তীক্ষ্ণ ধার , সকৌতুক সুর – – যা- ও এক হিসেবে কবিতার কাছাকাছি l
তবু এসব কবিতা নয় , আমরা জানি l আমরা জানি কবিতা এক শিল্প -প্রতিমা যাকে নির্মাণ করতে হয় l  এই ‘ নির্মাণ ‘ – এর সমস্যাই কবির সমস্যা যেখানে গ্রামের মানুষের কাব্যগুণসম্পন্ন ভাষা বা শহুরে পথচারীর তির্যক বাক্রীতি উপাদান মাত্র l
আর এখানেই গ্রাম্য ছড়া বা লোকগীতির সঙ্গে সত্যিকার কবিতার পার্থক্য l  স্থান – কাল -পাত্রের যে পরিপেক্ষিত নিয়ে আমরা ছড়ার কাব্যরস উপভোগ করি সেখানে সেই গ্রাম্য কবির অ – সংস্কৃতি আবেগ এবং অ – শিক্ষিত পটুতা  সম্বন্ধে সচেতনতা আমাদের মনে কাজ কর l আমরা আমাদের বুদ্ধির একাধিক দরজাকে সচেতনভাবে বন্ধ করে রাখি , ফলে রসাভাস অনুভব করি না l কিন্তু একটি কবিতা পাঠের সময় আমাদের মনভাব পাল্টে যায় , বদলে যায় মাপকাঠি – এবং তা সঙ্গত কারণেই l
উদাহরণ হিসেব কুঁচফল বিষয়ে একটি গ্রাম্য হেঁয়ালি উল্লেখ করা যায় l হেঁয়ালিটি  এরকম : ‘ রক্তে ডুবু ডুবু কাজলের ফোঁটা ‘ l  কুঁচফল যাদের স্মৃতিতে আছে তাঁদের কাছে কাজলের ফোঁটা এবং রক্ত দুটির উল্লেখই স্বাভাবিক শোনাবে l কিন্তু ওই যে কাজলের ফোঁটাটিকে রক্তে ‘ডুবু ডুবু ‘ মনে হওয়া – এখানেই হেঁয়ালি নির্মাতার সেই বিরল ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে যাকে জীবনানন্দের ভাষায় বলা যেতে পারে ‘ কল্পনাপ্রতিভা ‘ l
রচনাটি উল্লেখযোগ্য কারণ এটি গ্রাম্য হেঁয়ালি l হয়ত এটি তীব্র কল্পনাশক্তির অধিকারিণী কোন অশিক্ষিত রমণীর সৃষ্টি l  হয়ত একজনের সৃষ্টি নয় – এর প্রথম পাঠ পরিমার্জিত হয়েছে অন্য আরেকজনের মুখে – এবং পাঠান্তরে ক্রমে এটি বর্তমান রূপ পেয়েছে – যা ছড়ার ক্ষেত্রে প্রায়শই ঘটে থাকে l
কিন্তু এটিকে যদি তার গ্রাম্য পটভূমি থেকে বিশ্লিষ্ট করে পাঠকের পাতে পরিবেশন করা হয় কবিতা হিসেবে , পাঠক বিমুখ হতে বাধ্য l কেননা কবিত্ব এখানে খণ্ডিত , তা সামগ্রিকভাবে শিল্পমূর্তিতে পরিণত হয়না , পাঠককে কোন পূর্ণতার আস্বাদ দেয় না l তাই এটিও , বলা যায় , কবিতার প্রায় l
হালের বাংলা কবিতার এরকম উজ্জ্বল পঙক্তিভরা সংক্ষিপ্ত রচনা দেখা যায় যাকে আমরা পছন্দ করি l কিনু এই ধরনের রচনার পেছনে এক ধরনের ‘ সহজিয়া ‘ মনভাব কাজ করে যা গ্রাম্য কবিরই স্বধর্ম – অশিক্ষিত পটুতাই যার সম্বল l  এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবির শ্রম – বিমুখতা l বোঝা যায় তিনি সংক্ষেপে দায় সারতে চান l এক হিসেবে তিনি তাঁর  আলগা কবিশক্তি দিয়ে পাঠককে চান ভোলাতে , প্রতারিত করতে l  সত্যিকার শক্তিমান কবির হাত দিয়ে যখন এবম্বিধ রচনা শুধু বেরোয়ই না , গ্রন্থভুক্তির মর্যাদাও পায় , তখন ভয় হয় , আমাদের কবিরা গ্রামের ছড়াকার মহিলাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করছেন নাতো ?
বস্তুত এ ধরনের রচনার সঙ্গে ছড়ারই মিল বেশি l  কিন্তু সেই মিল লোকপুরাণ ও লোকজীবন , লৌকিক শব্দ ও বাক্ রীতি ইত্যাদির সূত্রে আসে না প্রায়ই , যা এলে হয়তো কবিতা পেয়ে যেত নতুন মাত্রা , যা হত মুক্তিরই নামান্তর l  মিল শুধু শরীর ও স্বভাবের সেই সব লক্ষণে যা কবিতার পক্ষে প্রায় ব্যতিক্রমবিহীন ভাবে নেতিবাচক l সংক্ষিপ্ত এমন একটি রচনা টিকে থাকে একটি – দুটি উজ্জ্বল পঙক্তিকে আশ্রয় করে – তরে যায় ছন্দের টানে l  আবেগ ও মননের যে টানাপোড়েনে তৈরী হয় কবিতার টেক্সচার , যে শিল্পকলা তাকে দেয় স্পষ্ট অবয়ব – এখানে তা স্বভাবতই অনুপস্থিত l  শক্তিমান কবির হাতেই স্বাভাবিকভাবে এমন রচনা দাঁড়ায় বেশি l  কিন্তু প্যালগ্রেড সাহেব ইংরেজি গীতিকবিতার সেরা সংকলনটি সম্পাদনার সময় সেই যে শর্ত দিয়েছিলেন : ‘ that a poem shall be worthy of the writer’s genius ‘ সেই নিরিখে বিচার করলেই প্রতীয়মান হয় এদের সীমাবদ্ধতা l  তখন একটু ভাবলেই আমরা বুঝতে পারি যে , ছড়ার ক্ষেত্রে আমরা যেমন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির কিছু দরজা বন্ধ করে রাখি সচেতন ভাবে , এইসব রচনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে – যদিও অন্যভাবে l  এরা পাঠযোগ্যতা অর্জন করে আমাদের সংকুচিত প্রত্যাশার সুবাদে , এবং প্রতিভাবান রচয়িতার ব্যক্তিপরিচয়ে – যদিও রচনাটি সেই প্রতিভার যোগ্য নয় আদৌ l
কিন্তু ব্যপারটা একটু অন্যরকম হয়ে দাঁড়ায় যখন রচনাটি ছন্দে না লেখা হয় , এবং কবি যদি সংক্ষেপে না সারেন l তখন ছড়ার সাথে আপাত – সাদৃশ্য হারিয়ে এটি যে সমস্যা তৈরি করে তা আরও জটিল l বস্তুত পাঠকের সমূহ বিপদ তখনই l
তখন কবিতার মেদবহুল শরীরে আবেগ শিথিলভাবে ছড়িয়ে থাকে , প্রায়শ কোনো উজ্জ্বল পঙক্তি স্ফুলিঙ্গের মতো ছিটকে ওঠে না l  একটা আলগা কবিত্ব রচনাটিকে সেইসব ভাবালু চোখের পোশাকে ও আচরণে কবি -কবি মানুষের চেহারা দেয় যার সঙ্গে সত্যিকার কবিত্বের সম্পর্ক নেই আদৌ l
তবুও পাঠক এবম্বিধ রচনাকে প্রত্যাখান করতে সাহস পায় না ,এবং কারণটি খুবই অনুধাবন যোগ্য l  আমরা জানি কবির ভাষা সমসাময়িক ভাষাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায় , যার জন্য তা অনেক সময় সমকালীনদের কাছে নতুন লাগে l  এই নতুন ভাষায় লেখা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কবিতাও যেমন সমকালীন পাঠকের বোধে সম্পূর্ণ না পৌঁছুতে পারে তেমন নিছক অকবিতাও পাঠক প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধান্বিত হয় ,- কারণ নতুন ভাষার সমস্যাটি তার  অবচেতনে দুইভাবে কাজ করেl  মধুসূদনের যে প্রেমিক পাঠক ঈশ্বর গুপ্তর ভাষায় লেখা একটি অপাঠ্য পদ্যকে সাহসের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে পারত , হয়তো ততধিক অপাঠ্য এক অমিত্রাক্ষর রচনা সম্বন্ধে সংশয় কাটিয়ে উঠতে সময় নিত – তৎকালীন সাহিত্যপত্র পুস্তক -পুস্তিকায় যার ভুরি ভুরি পরিমাণ উদাহরণ মিলবে l তেমনি আজকের পাঠকও ছন্দে – মিলে বাঁধা একটি রচনার অপকর্ষ সম্বন্ধে যত সহজে নিঃসন্দেহ হয় ততটা সম্ভব নয় খুঁড়িয়েচলা অক্ষরবৃত্তের একটি নতুন ঢঙের রচনা সম্বন্ধে — যাকে সে প্রায়শ গদ্যছন্দ বলে ভুল করে l  শক্তিমান কবিদের হাত দিয়েও হামেশা বেরোয় ‘ অভ্যাস – তাড়িত ‘ এমন আলো – তাপহীন রচনা,নতুন ভাষার মোড়কে l  প্যালগ্রেভ- কথিত ‘ serious imperfection in clearness , unity or truth ‘ তখন নতুনত্বের বেনিফিট অব্ ডাউট পায় l
একথা অনস্বীকার্য যে ক্ষীণবয়ব ‘ শোলোক ‘ বা শিথিল পদ্য ,টগবগে স্বরবৃত্ত বা খোঁড়া পয়ার — যা – ই লেখা হোক না কেন –পেছনে কাজ করে একটি সক্রিয় কবিস্বভাব l  এবং ‘ যে কোনো সৎকবিতাই স্বভাবকবিতা ‘ – শুনিয়েছিলেন জীবনানন্দ l  কিন্তু এ -ও তিনি শোনাতে ভোলেননি য় স্বভাবকবিতা মাত্রই সৎকবিতা নয় , কেননা কবিতা হল ‘ জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল জিনিস ;  কিংবা জীবনকে কোনো আলাদা জগতে নিয়ে নতুন করে তাকে সৃষ্টি ‘ l  এই সৃষ্টি – প্রক্রিয়া যাতে কবিপ্রেরণা কাজে লাগায় আজীবন আহৃত অভিজ্ঞতাকে , শোনে ‘ সংস্কার -মুক্ত তর্কের ইঙ্গিত ‘ , অত্যন্ত জটিল এবং নয় অনায়াসলভ্য l  তিনি তাই জানিয়ে দেন তাঁর পক্ষে ‘ ভালো কবিতা লেখা  অল্প কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার নয় l ‘ জীবনানন্দই এখানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ,কারণ দীর্ঘ বিলম্বিত অক্ষরবৃত্তের মায়াবী আলোয় তাঁর আবছা মুখ স্বভাবকবির বলে মনে হয়েছে কারও কারও l  অথচ তাঁকে সতর্কভাবে অনুসরণ করলেই বোঝা যায় অজস্র স্বভাবকবির মধ্যে মেধা ও অনুশীলনের বিচারে কেমন করে জন্ম নেয় একজন সৎকবি , অজস্র স্বভাবকবিতার মধ্যে অল্পসংখ্যক কিছু কেমন করে হয়ে উঠতে পারে সৎ কবিতা l  পাঠকের দেখবার সেটিই : কোনটি হয়ে উঠলো স্বভাবকবিতা থেকে সৎকবিতা , কবিতার প্রায় থেকে কবিতা l

 

(সংবেদ , আশ্বিন ১৩৯২)

আপনার মন্তব্য এখানে রাখুন