কবিতাডিহি : মার্চ


        

কবিতা বহুধা ও বহুবিধ

কবি নিজের কবিতাকে চেনেন, তাঁর কবিতাবিশ্বাসে, নিজের কবিতায় তাঁর আস্থা কি ‘অন্য’কে অস্বীকার করতে শেখায়? অন্যকে ধ্বংস না করলে কি নিজের প্রতিষ্ঠা হয় না?

কবি কি ক্রমে এক আত্ম-প্রতিষ্ঠানের কুহকে আক্রান্ত?

কবিতাডিহি হোক সকল স্বরের, আবহমানের, বিকল্পের, নিরীক্ষার।

সমবেত ও সর্বস্ব।

পাঠক, সহায় হ্যোন

 

 

                                                                                                                                                  

বই কথা

ভজন দত্ত




বর্তমানে যাঁরা কবিতা লিখছেন তাঁদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম সৌম্যদীপ রায়। কোলকাতা বইমেলা১৭ লক্ষ্য রেখে ডিসেম্বর ১৬ তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ " আকাশ দূরত্ব দূরে "।

চারফর্মার বইটিতে আছে মোট ৫৩ টি কবিতা।
 বিভিন্ন বিষয় ও স্বাদের কবিতা সংকলিত হয়েছে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে। যেগুলি থেকে সহজেই চেনা যায় কবিকে। এই প্রজন্মের কবি সৌম্যর কবিতার  শিরোনামগুলি দেখুন পাঠক, বুঝতে পারবেন তাঁর বিষয় বৈচিত্র।
 ইনার্শিয়া,ট্রেন,আলমারি,
 বাসস্টপ, হলুদ ট্যাক্সি,ভ্যানিটিব্যাগ,
 ক্রাইসিস, পজিটিভিটি,ডিওডোরেন্ট,হ্যাকার,কার্ফিউ এলাকা,বেলুন,
 ড্রোন মেশিন,
 পেপার ওয়েট,ডাইমেনশন,
 হিপনোটিজম,থিয়েটার,
 f(আমি), (a+b)^2.

কবি প্রায় কুড়ি শতাংশ কবিতার নাম রেখেছেন ইংরাজি ভাষায়।এভাবেই পৃথিবীর সব দেশের ভাষা পুষ্ট হয়। ট্রেন,বাস,ট্যাক্সি,বেলুনের মতো অন্য শব্দগুলিও যদি বাংলা অভিধানে স্থান লাভ করে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বর্তমান প্রজন্ম এই ভাষাতেই সাবলীল। কবি সৌম্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম।তিনিও তাই এই ভাষাতেই লিখছেন।

আসুন পড়ে নিই তাঁর কবিতার কিছু লাইন। প্রথম কবিতার (ক্রমশতম)
 শেষ লাইন
 " তাই আমি শুধুই ক্লিক ক্লিক ক্লিক "।  সাধারণ যে সব কথা আমরা প্রায়শই বলে থাকি, তাই দিয়েই  তিনি তৈরী করেছেন তাঁর কবিতা।'চোখ' কবিতায় তিনি লিখেছেন এক গভীর উপলব্ধির কথা -
 " শুধু কেঁদে গেলেও কখনওই হালকা হয় না চোখ "।'অর্বাচীন' কবিতায় তিনি লিখলেন -" সব কিডন্যাপ হয়ে গেল একদিন বিভিন্ন পত্রিকায়"।
 কবি দেখেন সাদা কেডস জুতোয় মরচে ধরেছে
 ( আজকাল)।"বালিশ, মশারি/ সবকিছুর সঙ্গে রক্ত রক্ত খেলা / আর মাঝে মাঝেই মনে হয়/ আমারও কেন রক্তস্রাব হয় না।"(ঘুম)।"এখন কোন মুখোশ আমাকে মানাবে জানতে/ স্ক্রিপ্ট রাইটারের কাছে খসড়া চাইছি।"         ( মুখোশ),
 "দুনিয়াময় দুর্বার ডিজিটাল শ্লেষে"র মধ্যে দিয়ে কবি হেঁটে বা ছুটে চলেছেন।লিখছেন এই সময়ে দাঁড়িয়ে কবিতা। তাই যা কিছু দেখছেন,উপলব্ধি করছেন সব কিছুই তিনি
 " সমানুপাতিক আদর " দিয়ে তুলে ধরেছেন। পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেছেন কবিতার রূপ ও বিষয়বস্তু নিয়ে। তিনি যেন গবেষকের মত অনুসন্ধান করেছেন অক্ষর, শব্দ,ভাষা, রূপ সবকিছু । আছে সনাতন,আধুনিক,
 পূনরাধুনিক,
 গাণিতিক, জ্যামিতিক,
 দৃশ্য কবিতা সবকিছুই। একমলাটে এত কিছু!  বিস্ময় জাগে।

অবাক হই যখন প্রিয় কাউকে দেখি কবির          " মা " কবিতাটি পড়ে তিনি কাঁদছেন। ভাষা পাই না তা প্রকাশের।
 পাঠক পড়ে দেখুন নিজেই।
 কবির পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের জন্য অপেক্ষা করবো অধীর আগ্রহে। লিখে যান।অনন্ত শুভেচ্ছা।

আকাশ দূরত্ব দূরে  । কবি সৌম্যদীপ রায় । অভিযান পাবলিশার্স। মূল্য ৮০টাকা

বাঁকুড়া শহরে ৫ম লিটিল ম্যাগাজিন মেলার শেষদিনের ( ২৩ শে জানুয়ারি'১৭) দুপুরে এলো জয়ীতা l ব্যাগ থেকে একটা সুন্দর মলাটের বই বের করে হাতে দিলো l মেলায় ঘোষণা হল সেকথা l সবাই করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করলেন জয়ীতা'কে l  অনেকেই এই প্রথম দেখলেন কবি জয়ীতা কে l লজ্জায় যতটা লাল হওয়া যায় তার থেকে বেশি লাল হয়ে গেছে সে l  সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলাম , ও আমার বোন l "কই দেখিনি তো আগে "- বলে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করলেন l  আর যাঁরা নিয়মিত ফেবু করেন ,চেনেন কবি জয়ীতা কে l তাঁরাও অভিনন্দিত করলেন l
 পিয়ালী  ও জয়ীতা - দুজনের প্রথম যৌথ কাব্যগ্রন্থ l পাঁচ ফর্মায় প্রথম পর্বে জয়ীতার আছে ত্রিশটি কবিতা,পিয়ালীরও l কী  করে এত সুন্দর ভাগ করলে তোমরা !

জয়ীতার "কয়েকটি দৃশ্য এবং তুমি " কবিতায় দেখলাম , সেল ফোন হাতে কবি কেমন আস্তে আস্তে পেঁয়াজের খোসার একেকটি পরত খোলার মতো তুলে ধরেছে এক চিরন্তন নারী কে l সে প্রেমিকা ,মা , গৃহবধূ ,কর্মরতা নারী l ঘরে -বাইরে কাজ করার পরও তাই সে লিখতে পারে - " রাত হয়েছে একটু / কাঁধের ব্যাগ ,ঘামে ভেজা শাড়ি ,চার্জ ফুরানো ফোন / একসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোমার সাথে / রান্নাঘরও তোমায় খোঁজে দিনের শেষে একটিবার /" - পাঠক লক্ষ করুণ কী সহজ -সরল -সাবলীল রোজকার মুখের কথাগুলি দিয়ে সে কি অপরূপ দৃশ্যকল্পই তৈরি করলেন l  তার সাথে ভাবুন , " রাত হয়েছে একটু " তার পরের কথাগুলি l এ আমাদের পাশের বাড়ি থেকে উঠে এসে কোথায় জায়গা নেয় - রান্নাঘরও খুঁজে নেয় ! কটি লাইনে একটি আধুনিক নারীকে খুঁজে নিতে কি খুব কষ্ট হয় ! পাঠক পড়ুন , চিনুন , চিঠি পাঠান ' জোনাকীর ডাকবাক্স 'এ l

পিয়ালীর কবিতার সাথে এ আমার প্রথম পরিচয় l কি অসাধারণ লিখেছেন তিনিও l " আমার ডাকবাক্সে তালাচাবি নেই , ঘুনও ধরেনি এতটুকু / আমাদের আলমারি নেই কোনো ..../ ( জোনাকীর ডাকবাক্স ; পৃ : ৬৫) -পড়ি l মুগ্ধ হই l এক বিমূর্ততার মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে তিনি দেখান -" দিগন্তের ডাকবাক্সে তখন নক্ষত্রের মত ছোটবড় রঙীন ঘাস " l  সাহসী লেখা - " পুণ্যতোয়া "( পৃ : ৫১) l কবি লিখেছেন " প্রতিদিন ভিজতে ভিজতে আমি তখন সুজলা সুফলা / তার সাথে সম্পর্কটা  ঝিমিয়ে এসেছে হঠাৎ / হাতের মুঠোয় ধরে রাখা বাদামী স্তন / ঈর্ষার বিষ দাঁত কাটে /" - "ঈর্ষা "র ব্যবহার করে কবিতাটিকে হঠাৎ এক পুণ্যতোয়ার স্বচ্ছতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কবিকে "পাপী " করলো না ,তিনি যতই বলুননা কেন ! " নামগোত্রহীন " - কবিতায় তিনি লিখেছেন- " ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে নোনতা বিষাদ / ধানক্ষেতের মত শূন্য করতল পাতা আছে /" - কি অসাধারণ ভাবে ধানক্ষেত কে তিনি ব্যবহার করেছেন l কৃষক (.পড়ুন পাঠক ) যদি কৃষিকর্ম জানেন তবে ছুঁয়ে দেখুন কবির কবিতায় ' নির্বিকল্প ইচ্ছেগুলি ' , ' বৈবাহিকী ' - কবিতায় কবি লিখেছেন " আলটুসে সম্মত শরীর এখন দূরে দূরে রাখি " - "আলটুসে "- শব্দটিই একটি পূর্ণ কবিতা হয়ে ধরা দিয়েছে l  কবি " জরিবোনা জ্যোৎস্না" য় লিখেছেন - " আমাদের পতন কাব্যের ব্যখ্যা সারারাত সাঁতরাবে ওই জরিবোনা জ্যোৎস্নায় "l

জয়ীতা ও পিয়ালীর যৌথ প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলেও কেউ তা বলতে পারবেননা , তাঁরা না জানালে l  ব্যক্তিগত ভাবে জানি ,ওরা দুজনেই নিরলসভাবে কবিতা অনুশীলন করেন l কবিতা ওদের মননে ,যাপনে l  আগামীদিনে ভালো থেকে আরো ভালোর প্রত্যাশা পূরণে তারা সক্ষম l  প্রিয় পাঠক , তাদের পাশে থাকুন ,সহায় হোন l
 পাঠ প্রতিক্রিয়া - ভজন দত্ত

জোনাকীর ডাকবাক্স ।পিয়ালী বসু ঘোষ ও জয়ীতা ব্যানার্জী গোস্বামী । জ্ঞানপীঠ পাবলিকেশন ।মূল্য : ১০০ টাকা মাত্র
 




  অনিন্দ্য রায়  

 ‘লেখক কর্তৃক প্রকাশিত’ বইটির নাম আর সেই লেখক নীলাব্জ চক্রবর্তী, এমন একটি নামে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দেন তিনি, প্রচ্ছদের ছবিও তার, এভাবে, লেখক কর্তৃক নির্মিত একটি কবিতা পুস্তকের মুখোমুখি হই, হ্যাঁ, নির্মাণ যা কবিতাকে পাতা ওলটানোর মুহূর্তে আর শুধু লেখকের রাখে না, পাঠকেরও,
“ আমাদের সেতু জুড়ে
কিছুটা বাদামী ছিল এই হরফ বিনিময়”
সেই হরফের, কবিতার, বইটির এক হাতবদলের প্রকরণ হয়ে বিনির্মাণ , শেষ পর্যন্ত ।
যেখানে
           “ শব্দ এক প্রবণতা
            ভাষার অক্ষ বরাবর ঝুঁকে আসা পুরনো বিকেল
            তাকে সমীকরণ বলো
           আর বড় হয়
            তোমাদের বহুদিন একঘন্টা বাড়ির পথ
           হ্যালো বলতে বলতে
           খুলে রাখা কবিতার লাইন
           জলের ভেতর চলে যাওয়া
                সহজ
              পাথরের সম্পর্কের ভেতর আরও”

তো, তিনি, এইভাবে দৃশ্য ও ধ্বনির মন্তাজে তৈরি করে এক নিরাবয়ব, যা অনির্দেশের পথকেই বানাতে চান  পাথর-যুক্তির ক্রিয়াহীনতার পাল্টা জল-লজিকের চলনে।
আর নীলাব্জর কবিতা হয়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব, কেরামতিহীন, ফ্লুইডযথা । পাঠককে আর্দ্র করে। এবং পাঠের গভীরে আরেক পাঠের দিকে নিয়ে যায়।
“ সাদাকালো গলিতে ছড়িয়ে পড়ছে টুকরো টুকরো প্যানারোমা। হটস্পট । তখন, নগ্নতা, একটি পূর্বনির্ধারিত ধারণাটুকু…”এই, নগ্নতা-র দুই দিকে দুটি কমাচিহ্ন বসিয়ে, নগ্নতাকে আড়াল করাটুকুই কবিতা, যা নীলাব্জ কর্তৃক প্রকাশিত।




  লেখক কর্তৃক প্রকাশিত । নীলাব্জ চক্রবর্তী। লেখক কর্তৃক প্রকাশিত। বিনিময়ঃ ১০০টাকা।

______________________________________________

     “হাজার বছরের বাংলা কবিতায়
     বিরামচিহ্ন দাগি আসামীর মতো
     অবৈধ চুমু খায়

     যে কোনো কর্মবিরতির পর
     স্বপ্ন আসে অক্ষরজ্ঞানের
     বাংলা কবিতার বিরামচিহ্ন
     আমার কমা ও কোলন চেপে ধরে
     মাতৃভাষায়”

এইভাবে শুরু হয়, অভ্রদীপ গোস্বামীর ‘বিরাম চিহ্ন’ বইটি, যা প্রকৃতই নূন্যতম বিরামচিহ্ন বহন করে এবং ‘চেপে ধরা’ মাতৃভাষাকে একটু খোলা বাতাসের মাঝে নিয়ে আসতে চায়।
    “ স্পেস। স্পেস, স্পেস যতখুশি দাও
     বোঝাতে চেয়ো না আর কিছু
     কমা ও কোলন তুলে ফেলো পবিত্র জলে
     বক্তব্য বিষয়ও যা কিছু”

হ্যাঁ, এই স্পেস্টুকুই এই বইটিতে আমাদের লক্ষ্য, যা প্রচ্ছদে বিরাম ও চিহ্ন – এই দুটি শব্দকে পরস্পর থেকে স্পেস ব্যবহার করে একটু দূরত্বে রেখে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এবং মাতৃভাষা, মা হয়ে ছড়িয়ে থাকেন সর্বত্র

    “ জলপানের কৌশল মা না শেখালে
     কিছুতেই বিষাক্ত মদ পান সম্ভব হত না
     এ জীবনে”

তাঁর যাপন থেকেই কবিতা, কবিতা নিয়েই যাপন। বাংলা ভাষায় এক বিরামচিহ্নহীন মুক্তাঞ্চল সূচিত করেন তিনি।


বিরামচিহ্ন । অভ্রদীপ গোস্বামী । ঋত প্রকাশন । বিনিময়ঃ ৭৫ টাকা

___________________________________________________________________________________________________




শব্দ ও তার অর্থের লিনিয়ার সম্পর্ক স্বীকার করেন না যিনি, তিনি কবি। আর কবিতা তৈরি হয় এই অস্বীকারের সম্প্রসারণ থেকে।
“ একজন তোমাকে দেখলে
পোশাক ঝুলে পড়ে চামড়া মাতা নীচু করে
পারমিশন দেয়। হ্যালোজেনের আলোয় দৃশ্য কাতরতা
শুরু হলে কিছুই থাকে না দ্রুত স্বাস নেবার …”
এইরকম উচ্চারণে, বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক হইচই থেকে ভিন্ন এক স্বরে কথা বলেন বিশ্বজিৎ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ,’ হ্যালোজেন ও স্পর্ধাগুচ্ছ” ।
।বইয়ের প্রতিটি কবিতাই তাঁর একেবারেই নিজস্ব। অনুভূতির গভীরে যে আলোড়ন, ভেঙে যাওয়া অভিজ্ঞতার দরজা দিয়ে ঢুকে আসা প্রবল ঢেউগুলি তিনি ভাষায় অনূদিত করেন। এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, তাঁর মনস্কতা সেই ভাষায় মূর্ত হয়ে ওঠে।
“ সর্বত্র শিরার ট্রাম গাড়ি নাগরিক ডালিম দানা
পেরিয়ে গ্রামীন তুলসীতলার ভোল বদলে দেয়
সরু চুলের ধারালো হাসিতে শালিমার থেকে
এখন আর বেলফুলের সমঝোতা চাই না”
এই সমঝোতা না করার মানসিকতা নিয়েই তাঁর লেখালেখি। শব্দ, বাক্য ও লাইন বিন্যাসে তাঁর সচেতন প্রচেষ্টাগুলি তাঁকে আরও আলাদা করে তোলে।

হ্যালোজেন ও স্পর্ধাগুচ্ছ । বিশ্বজিৎ দাস । ধানসিড়ি । দাম ঃ ৭০ টাকা

_________________________________________________

যে কোনো সম্পর্কই বাইনারি আর যে কোনো ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকা উচিৎ - এই দুই সুত্রের মুখোমুখি একটি কবিতার বই, “ আমি তো মাছির গায়ে বসি না,মাছি বসে কেন” । আপনি যখন বইটি পড়া শেশ করবেন, বুঝতে পারবেন মাছি ও ‘আমি’ দুই ততক্ষণে উড়ে গেছে।
তাহলে ? কী রইল ? কবিতা শেষ পর্যন্ত কবিতাই রয়ে যায়, মাছি নয়, শ্লেষ নয়, কবির ছন্দজ্ঞান বা শব্দ ব্যবহারের চমৎকারিত্ব নয়, নিরীক্ষার আশ্চর্য নয়, শুধুমাত্র কবিতাই রয়েছে এই কাব্যপুস্তিকাই।
“আমি আসলে এক নিরাপদ বিছিন্নতা। তুমির বাইরে আছে সমূহ জগৎ । এই দুটি ধারণার মাঝে       অর্ধবৃত্তাকার সেতু । তার টপে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি বা সিগারেট আমাকে । অনেক নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সময়। আঙুলের টুসকিতে কে অপরকে ছুঁড়ে ফেলবে, সিগারেট আমাকে নাকি আমি সিগারেটকে, তা এখন অবাস্তব।
বলবো বলবো, আপাতত ধোঁয়া চলুক”
আমরা অপেক্ষা করি। ধোঁয়া ক্রমে কেটে এলে দেখি
।“ হিংসা ও সৃষ্টির ঘরে পতঙ্গবিলাস
স্মৃতিস্তূতিকে নূপুর পরাচ্ছি
পরিব্যাপ্ত করছি তোমায়
তোমার মেরুদন্ডে যেটুকু ফাঁক, তাতে
তিনটে স্থলপদ্ম ধএ জায়
ঠাসাঠাসি না, একটাই রাখলাম”
এই তো সুপ্রিয়, কবিতা লিখতে চান শেষ পর্যন্ত

আমি তো মাছির গায়ে বসি না,মাছি বসে কেন । সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু বিঘে দুই। বিনিময় ২৫ টাকা

কবিতাডিহির নিজস্বী

কাজ চলছে আমাদের International anthology of visual poetry and visual text art০এর।প্রথম অংশ প্রকাশিত হবে কয়েকদিনের মধ্যে, পৃথক একটি ওয়েব ঠিকানায়।

কবিতাডিহি অনলাইনের পরবর্তী সংখ্যা ট্রিওলেট নিয়ে। অগ্রহীরা যোগাযোগ করুন।

দূর নক্ষত্রের আলোঃ শক্তি সেনগুপ্ত

শক্তি সেনগুপ্ত

জন্ম- ৪ঠা অক্টোবর, ১৯৩৭

কাব্যগ্রন্থঃ    বড় ঘড়ির তলায় (১৯৯৫)
যাবো অভিজিৎ মাসে ( ১৯৯৭)
জিনোম ও য্মচিত্র ( ২০০১)

প্রবন্ধ সংকলনঃ  দামুন্দা কপিশা শিলাবতী  (১৯৯৮)

প্রয়াণঃ  ২৬শে ডিসেম্বর, ২০০৫

___________________________________________________________________

যাবো অভিজিৎ মাসে

বারো পূর্ণিমায় তুমি সম্বৎসর কাটালে কৃপণ
অথচ চাঁদকে দিলে সাতাশ নক্ষত্র অধিকার
ওই বঞ্চনায় ক্ষুণ্ণ তারাদের অধিবাস, আর আমার ছিন্ন পরমায়ু
আর কি ফিরিয়ে দেবে সাতাশটি চান্দ্রবার, রাহু ও কেতুর নামে বার?

সে রকম হলে এই কালদন্ড আমি যবিষ্ট অগ্নির কাছে
নিজেই অর্পণ করবো, ভাসানমুকুরে স্বর্ণপ্রতিমার গলে যাওয়া
দু দন্ড দাঁড়িয়ে দেখব, হেমন্তকে ডেকে  বলবো
ঐ তো সবুজ বর্ণ চলে যায়, তুমি যাকে দেখতে চেয়েছিলে

উত্তর আকাশে অই সাতাশ আলোকবর্ষ দূরে
শূন্য অভিজিৎ, শূন্য তার শক্তির ধ্রুবক
সেখানে পূর্ণিমা হলে একক নীলাভ তারা জন্ম নেবে
এক কণা শূন্য পরিসরে।

তার অভিকর্ষে আমি সাতাশ নক্ষত্র পার হয়ে
যদি রোহিনীউদয় দেশে যাই
যাবো অভিজিৎ মাসে, কেতুবারে।“

    ( কাব্যগ্রন্থঃ যাবো অভিজিৎ মাসে)

Continue reading

লিউক ডেভিস

লিউক ডেভিস

(জন্মঃ ১৯৬২ । সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো ।

উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থঃ

   Four Plots for Magnets,

  Absolute Event Horizon,

  Totem and Interferon Plasm

 


জনপ্রিয় চলচিত্ Candy তাঁর উপন্যাস ভিত্তি করে নির্মিত।

অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক লেখালেখিতে উজ্জ্বল এই নাম।)

 


হিংসার ইতিহাস
•
নিসর্গচিত্রে
মাংস

মাংস সরে গেলে
নিসর্গ

প্রস্তরে
ইতিহাস ধুকপুক করছে

আমাদের ছাড়িয়ে,  আমাদের তলায় চুপ ক'রে
অভীপ্সার সেলাই

বৃষ্টিতে
ইরেজার এবং

হাওয়ার স্তম্ভে
আর লবনের স্তম্ভে-

স্মৃতির এলোমেলো
নেমে আসছে ভার

পাথরেরা ঈশ্বর মানে না

তাঁর বুকে
জড়ো হয় পৃথিবী

তাঁর রক্তাক্ত শ্বাসপাতের
আস্তরণে

ঈশ্বর মনে রাখতে পারেন না কিছু
কখনোই

-পারেন না
 চানও না-

তিনি মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন এইভাবে




ছোটবেলার ভয়

একটা চৌমাথা।  ঝোপঝাড়
আর খাঁড়ি।  বাবা আর আমি
একটা দুষ্টু তিতির টোকা মেরেই ফুড়ুৎ
ওর খোঁজে ঝরনার কিনার অব্দি যাই
প্রতিশোধে।

বিকেল ফুরিয়ে আসে। কালো পাখিটি   যায় উড়ে ।
আমার কান্নাও থেমে এল। আমার হাত ধরে বাবা
ঢিল ছুঁড়ছে ফাঁকা গাছপালায়
"হুশ হুশ" চীৎকার করছে
সেই অভিনয় দেখে  ভালবেসে ফেলি বাবাকে আমার

                  অনুবাদঃ    ভাস্বতী গোস্বামী
                               অনিন্দ্য রায়

মুখোমুখি বসিবারঃ কবিতাডিহির সঙ্গে প্রদীপ চক্রবর্তী

অনিন্দ‍্য রায়ঃ কেমন আছ?
 প্রদীপ চক্রবর্তী: কেমন আছো এই শব্দ গুলোই আজ আমাকে প্রতিপ্রশ্ন করে,…কেমন আছি এই পৃথিবীতে প্রায় ৪৬বছর ধরে …একটা গ্লাসের অর্ধেকটা ভরা, অর্ধেক খালি …তার সেই দোনোমোনো অবস্থার মতোই, নানা অনুভব ,নানা ঘটনা ,নানা টানাপড়েন এর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কখনো মেঘ কখনো শরতের আকাশের মতো এই ভালো এই খারাপ …আজগের পৃথিবীতে একজন স্বপ্নঘোরে থাকা বিবেকবান বিষাদি মানুষ যে ভাবে বাঁচতে চায় অথচ পারে না, সে ভাবেই আকাশকুসুম বেদনায় বেঁচে আছি …যাই হোক চলে যাচ্ছে …তুমি কেমন আছো অনিন্দ্য …আমরা পুরনো বন্ধুরা একটু কাছে কাছে থাকলে হয়তো আরো মজার হবে বাঁচা …কি ?তাই তো?

অনিন্দ্য রায়ঃ ‘বন্ধুত্ব ‘ এই শব্দটি কবিতার সাথে আদৌ জড়িত? না কি তা আড়াল করে অনেক অসঙ্গতিকে, অক্ষমতাকে?
প্রদীপ চক্রবর্তী: ধুস …বন্ধুত্ব নিয়ে কয়েক হাজার মাচা কাঁপানো নাটুকে সংলাপ লেখা হয়েছে …হাজার হাজার আবেগ সর্বস্ব স্লোগানধর্মী কবিতাও …কিন্তু সরাসরি কবিতার সাথে বন্ধুত্ব যাবে কী করে ?…যদিও কবিতা লিখে এক সময় ভাবতাম মেয়েরা পটবে …! বেশ মাখো মাখো রোমান্টিক ইয়ের কবিতা লেখারও দুর্নিবার চেষ্টা চালিয়ে গেছি গুরু …লেগে থাকা কাকা …!কিন্তু দুর্ভাগ্য একটাও জমেনি …আমি শালা জন্ম আদম খোর …বেদরদী …এখনো বুঝতেই পারলাম না কবিতা কোন্ কার্বাইডে জমে …! যাই হোক ,জোকস অ্যপার্ট …আসলে তুমি  বলতে চেয়েছ বন্ধুত্ব কি আড়াল করে ,বন্ধুদের লেখালিখির অনেক অসঙ্গতি অক্ষমতাকে …
দেখো ,কোন আন্দোলন ,কোন দল ,গোষ্ঠী ,লবিবাজ জাঁহাপনা ,কোন দিন কোন কবিকে তৈরি করতে পারেনি …পারেও না …কবির পথ চলা একার …তবে সে সামাজিক …তার একটা সংস্থা এবং সামাজিক মুখোশ আছে …সে জানে সে সাধারণ …মানে কিনা বলতে পারবো না …তবে সে কখনোই সন্ত ,সত্য সাঁই ,গুরুদেব বা কাল্ট নয় …একজন সাদায়কালোয় মন্দভালোয় গড়া বড় জোর রঙ্গীন চরিত্র মাত্র …তার আছে কেবল অফুরোন বেঁচে থাকার একান্ত মানসিক কৌশল বা কাল্পনিক অভিজ্ঞতার জগত…তবে কবি লিখতে লিখতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে …তার শুভাকাঙ্ক্ষী যদি কেউ  থাকে তাহলে খুশি হয় …
বুদ্ধদেব বোসু কে ,বরিশালের জীবনানন্দ কতোটা প্রাণের দোসর মনে করতেন জানি না …কিন্তু একটা বিশ্বাসী সমর্পণ তো ছিলো …
সেটা শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে মৃত্যু শয্যায় শুয়ে অসহায় জীবনানন্দের আকুতি ও বুদ্ধদেবের হাত আঁকড়ে ধরার মধ্যে ব্যাকুল ভাবে ফুটে ওঠে …বুদ্ধদেব জীবনানন্দের লেখার জন্য জীবন পণ করে বাজি ধরেছিলেন …সঞ্জয় ভট্টাচার্য আরেকজন …কি কাজ না করেছিলেন জীবনানন্দের লেখার ওপরে …!আহা …!নাগতলার কবিতা ভবনের বু .ব “র ঘনিষ্ঠ আরেক দিকপাল কবি ,বিষ্ণু দে …তো ,একসময় বুদ্ধ -বিষ্ণুর ,ভক্তদের বৌদ্ধ আর বৈষ্ণব বলে লোকে আওয়াজ দিতো …কোনও এক কারণে ,দুজনের মধ্যে ভুল বোঝা বুঝি হয় …এবং সেটা চরমে ওঠে …মুখ দেখাদেখি বন্ধ আর কি !…তো ,এমন ও হয়েছে ,বুদ্ধদেব কে দেখে ফুটপাত বদল করছেন বিষ্ণু দে …কিন্তু দেখো ,এই ঘটনা কোন ছাপই ফেলেনি লেখালিখির ক্ষেত্রে …কবিতা পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় ,বিষ্ণু দের লেখা খুব সম্মানের সংগে ছাপা হতো …সেই সব কবিতার স্বর্ণযুগের মূল্যবোধ আজ আর আশা করা যায় না …!তখন পারস্পরিক সাহিত্যধর্মী বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক গভীর ও সত ছিলো …এমন কি পঞ্চাশের প্রথিতযসা কবির কথা আমরা সবাই অল্প বিস্তর জানি ,রাতের কলকাতা শাসন করা ,দামাল ,দিকশূন্যপুরের সেই যুবক …এক বিশেষ সূত্রে জেনেছিলাম ,যিনি ধরে ধরে বন্ধুদের লেখালিখিকে পুরস্কৃত করেছিলেন …স্ট্রং রেকমেন্ড করতেন ,তাঁরা যাতে বড়ো পুরষ্কার পান …লিখে টাকা কড়ি …তো সেটা খারাপ কীসের !বন্ধুর কবিতার জন্য পুরস্কার বা অর্থমূল্য জোগাড় করলে কী ক্ষতি !…উপযাচক হয়ে ,নিজের ঢাক ঢোল না পেটালেই হলো …কবি পাঠক বা স্বীকৃতির জন্য হয়তো বা উপবাসী …কিন্তু সে দালাল ,বা ভিখিরি বা কাঙ্গাল হলে বড় বেজে ওঠে বুকে …বিলো অফ দ্য বেল্ট হয়ে যায় তখন …অথচ আজ সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ,আত্মপ্রচারের জন্য যে নোংরা রুচির পরিচয় পাচ্ছি প্রতিনিয়ত …যে অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ …যে ভাবে পরিকল্পিত ভাবে ,কাউকে হেনস্থা করার জন্য ছোটো ছোটো ঘোঁট পাকানো হচ্ছে,সেখানে না আছে বন্ধুত্ব না আছে সুস্থ রুচির পরিচয় …
তবে এটাও ঠিক ,কোন বন্ধুত্বই কারোর কবিতার দুর্বলতা কে ঢাকতে পারে না …শত চেষ্টা করলেও না …মহাকাল তার তুলো ধোনার যন্ত্র নিয়ে  ধুনুরির মতো ঠিক বসে আছে …ট্যাস গরু হলে ,ভূষি হলে ,তা এমনিই হারিয়ে যাবে …কোন ফুট লাইট …অ্যাকশন ….ক্যামেরা …অটোগ্রাফ …পুরষ্কার …তাকে বাঁচাতে পারবে না, তবু আজকের এই ভীষণ ও ক্রমশ একা হয়ে  যাওয়া পৃথিবীতে ,বিপন্ন ও বিপণনে পিষ্ট কবিও বড়ো অসহায় …তার তো ইচ্ছে  করে, পরানটারে গামছা দিয়ে সব সময় না বেঁধে একটু অকপট হতে ..কিন্তু শুনবে কে ?….সওদাগরি আফিসের মতো এখানেও সবাই কলিগ …মুখোশ বিবিধ …বন্ধুর মুখশ্রী বিরল।

অনিন্দ্য রায়ঃ তাহলে কবিতা কী? তা কি নিজেকে লুকিয়ে ফেলার ‘ মোহিনী আড়াল’মাত্র নয়?
প্রদীপ চক্রবর্তী: বাংলা গদ্যের বয়স দুশো বছর …প্রায় হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছে ,বাংলা কবিতা …অথচ এখনো এই বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেল এর অতল রহস্য পুরো পুরি কেও আবিষ্কার করতে পেরেছে কি ?…কবিতা নামক অতি জীবন্ত ,পেখম -এ পেখম -এ ,ছয়লাপ করা ময়ূর টা কি জানে ,কেন আকাশে এতো মেঘের ঘনঘটা দেখে তার চঞ্চল হয়ে ওঠে শরীরের যাবতীয় রক্তের আণবিক সুরজপত । এত পন্ডিতি তর্ক,নিরীক্ষা ,কূটাভাষ,প্রশ্ন ,এতো আন্দোলন ,কয়েক লাখ কবিতা ,ম্যাপলিথো ,তুলট ,ভূর্জপত্র ,নিউজ প্রিন্ট …এতো নিজেকে ছাপানোর জন্য বেকার শিক্ষক মন্ত্রী সন্ত্রী আমলা পুলিশ নায়ক নায়িকা সন্ত্রাসবাদী শুধু কেরানী …পাগল মাতাল বেবুশ্যে,সব্বাই ব্যস্ত …অথচ এদেশে ঘরের খেয়ে পরের বনের মোষ তাড়ানো ছাড়া ,বাইরের কোন সে অর্থে বস্তুগত বা আর্থিক প্রাপ্তি নেই …সবাই কোন পরশ পাথরের আশায় ছুটছে কবিতা পানে ,তারপর ও কি সে ভাবে বলা যায় কবিতা কী ?…
এখন ও  সেই প্রশ্নের কোন মীমাংসা হয়নি আমার কাছেও …! আরো প্রশ্নে আমি দ্বন্দ্ব জর্জর …!
কবিতা নিজেই নিজের  অন্দর -বাহিরের অভ্যস্ত ছক ভেঙ্গে ভেঙ্গে সেই সুদূর অতীত থেকে এ যাবতকালের ব্যাপ্ত বোধ ও চেতনার গহনে ডুবতে ডুবতে আরো জটিল মীমাংসাহীন এক অনন্ত পিপাসার দিকে নিয়ে চলেছে আমাদের
কবিতা ক্ষণকাল না চিরকালের? তার আবেদন মুহূর্ত-এর না শাশ্বত ?তার চাহিদা জনপ্রিয় হবার দিকে না নির্জনতার দিকে ?সে কি একই সংগে এক রৈখিক  না বহু রৈখিক ?সীমাবদ্ধ না সীমাহীন ?বাণিজ্যপ্রবণ না সাধনাপ্রবণ ?সে কি আদৌ লেখা কার্য না সৃজন কর্ম ?সে কি পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত সমাপ্তি  চায়, না অনিঃশেষ সম্ভাবনাজাত অসমাপ্তি ?তার সময় কি নির্দিষ্ট ? সে কি টাইম সার্ভার ?প্রতিবাদী ?জন মনোরঞ্জনের উপকরণ হিসেবে  আবৃত্তিকারদের ব্যবহারের জন্য বাজারি চাহিদা মাপা এক নিছক বাণিজ্য সম্ভার ?দুখিরামদের সমব্যথী কি কবিতা ?চট জলদি না তার সময় বোধ অফুরোন্ত ?সে কি শব্দার্থ বন্ধন ক্রিয়ায় বিশ্বাসী ?না বহমুখী টসটসে ফোঁড়ার মতো সুদূর অর্থক্রিয়ায় ?সে কি চটুল মুখপুস্তিকার বর্তমান লাইক সর্বস্ব কবিদের মতো সমুদ্র তটবর্তী আপত ঢেউয়ের নিছক ক্রিয়াশীলতায় মুগ্ধ না গভীর ঢেউ এর কেন্দ্র সন্ধানী ?
কী কবিতা ?কেন কবিতা ?কবিতা কি আদৌ রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের প্রহেলিকাময় অবগুণ্ঠন -এর আড়ালে থাকা মোহিনী ?না তার অতিরিক্ত কিছু ?…
কবিতা একেকজনের কাছে একেক রকম …জীবনের পাঁক ঘেঁটে ঘেঁটে কারো কাছে সুন্দরের অনুধ্যান ,কারোর কাছে আইস এক্স নিয়ে ক্রল্ করে করে অজানা সামিটে চলা …কোন স্টেক নেই …অন্ধকারের উত্স থেকে উৎসারিত আলোয় ননভিশন পথে পথে চলা …হাড়ের ভেতর দিয়ে হাড়ে মজ্জার ভেতর দিয়ে মজ্জায় যে স্পার্ক যে বাজনা বেজে ওঠে বোধে ও মননে তার ব্যথিত আনন্দের শব্দ গুলোই হয়তো খোঁজে কবিতা … এ প্রসঙ্গ শেষ করবো আমার একটা প্রিয় লেখা ,কবি মণীন্দ্র গুপ্তের চাঁদের ওপিঠ -এর কিছু স্মরণীয় অংশ মনে করে …আমরা পাঠকরা জানি ,কবিতা আমাদের মধ্যে কিছু একটা সঞ্চারিত করে ,ফলে আমাদের সংবীতকে সে,অন্তত কিছু সময়ের জন্য পরিবর্তন করে বা পরিবর্তনের দরজায় পৌঁছে দেয় …নিজেকে অপরের মধ্যে চালনা করার এই প্রতিভা ,এই সংক্রমন -ক্ষমতা কবিতার প্রাণময়তারই অনিবার্য প্রমাণ …কবিতার বৃদ্ধি ,বাইরে কোথাও ঘটে না ,ঘটে একমাত্র পাঠকের চেতনায় …আর ,আমার ধারণা ,একমাত্র এই বৃদ্ধির পরিমাণের নিকষেই মহৎ,ভালো ও দুর্বল কবিতা যাচাই হওয়া সম্ভব …কবিতার স্থায়িত্ব-এর পরিমাণ ও নির্ভর করছে ,পাঠক -চেতনায় তার এই সংক্রামক ও সমপ্রসারণ ক্ষমতার উপরে …আসলে কবিতার স্থায়িত্ব নির্ভর করে একান্ত ভাবেই তার নিহিত জীবনী শক্তির উপর …,উৎকৃষ্ট কবিতার দুর্মর জীবনী শক্তি অনেকটা যেন সেই বিশুষ্ক পদ্ম বীজের মতো ,যা হাজার বছর পরেও অনুকূল ক্ষেত্রে পুঁতলে আবার বেঁচে ওঠে ,ফুল ফোটায়, অনিন্দ্য …সেই মহাকালের রথে সূর্য্যের আটটি ঘোড়ার পদধ্বনি কি শুনছো না …শত সহস্র বছরের …
কবিতার ভাষা নিজস্ব …তার কোন বাংলা হিন্দি উর্দু হয় না …তার সাংকেতিক বিমূর্ত উৎস কবিতা এক মাত্র কবিই টের পান …কোনও তাত্ত্বিক বা পণ্ডিত নন …
(হাজার বছর পরে হবে )
অনিন্দ্য রায়ঃ চেতনা, অতিচেতনা, মহাচেতনা-
এই ধারণাগুলির সাথে সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-
কিছু বলবে?

প্রদীপ চক্রবর্তী: এই প্রশ্নের উত্তর আমি একটু অন্যভাবে দেবো …যত্সামান্য পাঠক হিসেবে এবং কবিতা লিখতে চাওয়া একজন ব্যক্তির কিছু অভিজ্ঞতার নিরিখে ,অতি সোজাসুজি সহজ ভাবে
নয়ের দশক শেষ হতে তখনও চার -পাঁচ বছর বাকি …বছর ২৪-২৫এর এক যুবক জামশেদপুরে কবি -প্রাবন্ধিক বারীন ঘোষালের টেলকো -লেক টাউনের ফ্ল্যাট থেকে একটি হলুদ মলাটের ,লেটার প্রেস এ ছাপা ,১৬০পাতার বই উপহার পেয়েছিলো …বইটির নাম, অতিচেতনার কথা ….
বই টি নিয়ে নতুন করে আর আমি কী বলবো ?…আমি সে সময় এম এ পাস করেছি …একটা কলেজে part time পড়াই …টিউশন করি …এবং দুর্ভাগ্য সৌভাগ্য যাই হোক ,স্নেহাশীষ ও শিল্পী সঞ্জয় রক্ষিত এর সংগে মিলিত প্রয়াসে একটি ক্ষীণকায় পত্রিকা করি,কুরুক্ষেত্র নামে …
: তো ,আমার বাংলা পড়া বিশেষ কাজ দেয়নি …যদিও গত ১৬-১৭বছর ধরে আমি একটি এইচ .এস স্কুলের বাংলা শিক্ষক ….নিয়ম করে অনেক সত্তার মধ্যে একটি সত্তা আজও, চেষ্টা করে মন দিয়ে পড়াতে …শেখানো বুলি ঠিক ঠাক ভাবে শেখাতে …আর এই দ্বন্দ্ব ,সে সময় তীব্র ছিলো ,সেই প্রথম অন্বেষণের সময় …আজ শান্ত হয়ে গেছে সেই মন …কেন ?কারণ ,পরীক্ষা পাশের জন্যই হোক ,আর জানার আগ্রহেই হোক ,আমি সে সময় ও তার আগেই মন দিয়ে হাজার বছরের বাংলা কবিতা ও ২০০বছরের বাংলা গদ্য চিবিয়ে চুষে যুত করে খেয়েছি …
যতটা পেয়েছি
কিন্তু সব ভস্ম-এ গেছে
লিখতে গিয়ে ,আমিই মনে হয় দুর্ভাগা ব্যক্তি ,প্রথম ,যে নিয়ম করে বাংলা সাহিত্য পাঠ করেও সেই একপেশে ছন্দে বা রবীন্দ্রনা, জীবনানন্দ,বিনয় কিংবা ৩০এর সমস্ত দিকপাল কবি ,৫০-৬০এর হইচই ফেলে দেওয়া কোনও কবির কোনও কবিতাই নকল করে উঠতে পারলাম না …যেখানে আমার সমসাময়িক বন্ধু কবিরা ,যাদের সংগে সে সময় মিসতাম আর কি ,তারা ঢের গুণ ভালো কবিতা লিখে ভালো ভালো পত্রিকায় নাম টাম করছে …তখন নিজের পাতার পর পাতা আং বাং লেখা ,আমাকে ভাবিয়ে তুলছে …আমার লেখা আদৌ কবিতা কিনা বুঝে উঠতে পারছি না …
পত্রিকা থেকে ফেরত আসে ..এক মাত্র দুর্গাপুরে অশোক মজুমদারদা ,মানবেন্দু রায় আমার কবিতা ছাপায় …আর প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি আর স্নেহাশীষ আড্ডা দিই ,কবি বিমান মাজির বাড়ি …তিনি প্রেরণা দেন …আর দেন নিভা দে …তার জলপ্রপাত পত্রিকায় দু একটি কবিতা ছাপেন …

: আমার কতো কষ্ট …প্রেম হীন জীবন …মুখচোরা …একা একা থাকতে ভালোবাসি …কিছু চাইনি সে-সময় …কেবল এতো কবিতা রাশি থেকে আমার যদি কেও এক গোছা কবিতা ছাপে …তার আগে রাগ করে আমার তিন তিনটে কবিতা ভরা খাতা পুড়িয়ে দিয়েছি
এক গোছা ,বেশ কয়েক পাতা আমার কবিতা ছাপালে আমি  কৃতজ্ঞতায় সেই সম্পাদককে মাথায় তুলে রাখতেও রাজি সে সময়
আর এভাবেই ইবলিশের আত্মদর্শন ঘটেছে যে কবির ,তার বাড়িতেই আলাপ হয়ে গেলো তরুণ সুদর্শন ধীমান চক্রবর্তীর সঙ্গে …আর সেই প্রথম আলাপের পর কেন যেন মনে হলো এই অনিন্দ্যকান্তি যুবকের সঙ্গে আমাকে অনেক পথ হাঁটতে হবে …আর হলও তাই …একসঙ্গে পত্রিকা করা ,ওঠা বসা …কবি ধীমান ,আমাকে দিলেন তার প্রথম  ব্রহ্মাস্ত্র…ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্তের প্রচ্ছদে শোভি,প্রথম কবিতার বই …আগুনের আরামকেদারা …
কিন্তু তা আর হল কই ?…সেই দুঃখ থেকে ,আমার মতো যারা প্রচলিত কবিতায় ঠাঁই পায় না ,সেই সমস্ত কবিদের লেখা নিয়ে ,ঠিক করলাম,বের করবো কুরুক্ষেত্র পত্রিকা …আর খুঁজে বের করতে থাকলাম সেই সমস্ত কবিদের
আমি আপ্লুত হলাম …পাঠক হিসেবে মনে হলো ,বাংলা কবিতার প্রথম পাঁচটা বই ,৫০দশকের পর থেকে শুরু করে আজ পর্য্যন্ত …এটি একটি …এর পর কতো অসাধারণ কবিতা কাজ দেখলাম ধীমান দার …কিন্তু এর রেশ রেখে গেছে আমার মনে সুদূরপ্রসারী …
যাই হোক ধীমান দার সঙ্গে প্রথম বারীন দার বাড়িতে যাওয়া …এবং অকপটে আমার কবিতা শোনায় , আগ্রহী প্রথম কাওকে দেখলাম
সেই সংকটজনক সংশয় থেকে ,আমাকে এক ঝটকায় নাড়া দিলেন অতিচেতনায় বিশ্বাসী এই ভদ্রলোক
তিনি আমাকে আজ পর্য্যন্ত ভাট উপদেশ দেননি …দাদা গিরি করেননি …আমি যা লিখি ,তার ওপর দাঁড়িয়ে নিজের মতামত দিয়েছেন …এ নিয়ে প্রচুর রাত জাগা আড্ডা হয়েছে ,তর্ক ,আলোচনা …বহু কিছুই মানিনি …মানিও না …কারণ কবি কোনও তত্ত্বকে মাথায় রেখে কবিতা লেখেন না ….
এই সময় এই মানুষটা ,অর্থাৎ বারীন ঘোষাল ,সেই নয়ের দশকে তার অতিচেতনার কথা বইটি দিয়ে আমার সেল্ফকনফিডেন্স কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন …তা আজ বলতে কোনও দ্বিধা নেই
এই সেল্ফকনফিডেন্স সেই সময় অনেকেই পেয়েছিলেন …সেটা তারা স্বীকার করুক আর না করুক
কিন্তু তাতে কী ?…আজ ২০১৭তে দাঁড়িয়ে কোনও কোনও ছোটো মনের কবিতা লেখক ,বলেন কাউকে কাউকে ,যে অমুক বারীন ঘোষালের চেলা …তমুক নকলনবিশ …কিন্তু সেটা হয় কী ভাবে ?
: রবীন্দ্র অনুসারী কবি বলে এক সময় ধুয়োউঠেছিলো কারোর কারোর বিরুদ্ধে …জীবনানন্দের নকল বলা হতো কবি বিনয় মজুমদার ,শক্তি চট্টোপাধ্যায় কে …সত্যি কি এই সমস্ত বড়ো মৌলিক কবিদের নকল হয় ?…ওপর ওপর শাব্দিক মায়ায় বড়জোর দিকভ্রান্তি হতে পারে …কারণ জীবনানন্দের নকল তো হয়ই না ….যে ওই ফাঁদে পা বাড়িয়েছে সেই সমূলে বিনষ্ট হয়েছে
: কবি অন্বেষণ প্রিয় …তার খোঁজ জীবন ব্যাপী …নিজস্ব পথ পাবার জন্য একজন কবি জাহান্নামেও যেতে রাজি …যদি তার তীব্রতায় ফাঁকি না থাকে …তাই শুরুর দিকে কিছু প্রভাব থাকে সবার …পরে নিজের কুলায় ফেরে শিকলি ছেঁড়া পাখি …
: এখন প্রশ্ন হলো অতিচেতনা মহাচেতনা (এই প্রসঙ্গে এখানেই বলে রাখি ,এই মহাচেতনার ব্যাপারটা হঠাৎ করে বলতে শুরু করেন আমার এক প্রিয় মানুষ ও ৮০-র কবি অলোক বিশ্বাস …ওটা ছিলো বারীনদাকে অতিরিক্ত ভালোবেসে অলোক বিশ্বাসের একটা সাময়িক উপঢৌকন …এটা বা এই মজার খেলাটা কবিরা তার প্রিয় মানুষজনের সঙ্গে মাঝে মাঝে করে থাকেন …একেতেই বাংলা কবিতার সঠিক পাঠকের খুবই অভাব …হয়তো জীবনানন্দ সকলেই পাঠক নন কেউ কেউ পাঠক বলতে গিয়ে অন্য কিছু বলে ফেলেছিলেন …আমোদগেঁড়ে বাঙ্গালী কবিতা পাঠকরা যে অধিকাংশ কী চিজ মাইরি ,উনি তা ভালোই জানতেন …এখনো জীবনানন্দের ২৫টা কবিতা না লেখা ,নির্ভেজাল পাঠক কি আছে ?…হুজুগে বাঙ্গালী চিরকালই প্রচার মাধ্যমের কাছে বন্ধকি রেখেছে তার বোধ বুদ্ধি )
: ইত্যাদি ধারনাগুলোর সংগে সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার যোগ সূত্র কতোটা ?…আমি আগেই বল্লাম ,আবার বলছি কোনও কবিই কোনও ধারণাকে মাথায় রেখে কবিতা লেখেন না …তাঁরা বড়জোর ,একই রুচি ও ভালোলাগার মানুষজনদের নিয়ে একটা অজানা বন্ধনের রসায়নে জড়িয়ে পড়েন বন্ধুতায় …বরং ,তার লেখার বিভিন্ন লক্ষণ ,শিক্ষা ,চিহ্ন ,বিগঠন ,বা অবিনির্মাণ ,চিহ্নক ও চিহ্নন্নের আপতিক সম্পর্ক তৈরী ও ভাঙ্গন ,উন্মুক্ত ভাষার বিপুলায়তন শূন্য পরিসর ,শব্দার্থ সীমা ভাঙ্গনের এক অফুরো নৈশব্দ ,এবং ভাষা ছাড়ানো ভাবনার বা কাল্পনিক অভিজ্ঞতার উপযুক্ত বিস্তার প্রক্রিয়ার ওপর দাঁড়িয়ে কোনও কোনও পণ্ডিত তাকে আবহমান,নতুন,পোষ্টমডার্ন কালখন্ডের কবি বলে চিহ্নিত করেন …কিন্তু তাতে কবির কিস্‌সু যায় আসে না … তুমি নিশ্চই আমার,স্বপ্নের জেহাদী ও অন্যান্য গদ্য পড়েছ ?…আমার কবিতা সম্পর্কে ভাবনার পরিচয় খুব স্পষ্ট করেই ওখানে পাবে …আমার চিরকালই মনে হয়েছে ,আবহমান ও অতি চেতনাশ্রয়ি কবিতা ভাবনার মাঝখানে ,মরা ঘুঘুর একটা দরজা আছে …আছে খাঁচা ভাঙ্গার খেলা ….আবহমান কবিতার মধ্যে থেকে অসম্ভব এক নতুনের দরজা খুলে দিয়েছেন এমন অনেক কবি …যারা জানেন নতুনের কোনও দুঃখ নেই …আবহমান এই সমস্ত কবি আমাকে তোড়ফোঁড় করেন …তাদের নতুন ও চির নতুন কবি বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই …যেমন , স্বদেশ সেন , সুধাংশু সেন ,তারক সেন ,সুশীল ভৌমিক ,মণীন্দ্র গুপ্ত ,শক্তি সেনগুপ্ত ,রঞ্জিত সিংহ ,দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়, শ্যামল সিংহ …আমি যেমন বারীন ঘোষালের আমার সময়ের কবিতা পড়ি …ঠিক তেমনি একই ভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের,চাঁদের ওপিঠ -এ, জন মানুষ বন মানুষ পড়ি …পড়ি রঞ্জিতদার শ্রুতি ও প্রতিশ্রুতি , বৃত্ত থেকে কেন্দ্র ..একই ভাবে স্বপন রায়ের ,রুয়ামের সংগে বা স্বর্গের ফোকাস …বিনয় মজুমদারের গদ্য ও ডায়রি …মলয় রায় চৌধুরীর গদ্য ও সাক্ষাৎকার …দেবীপ্রসাদ এর গদ্য …আমি এই সমস্ত অমূল্য বইয়ের মধ্যে দিয়ে ,চির নতুনের আহ্বান পাই …এই চির নতুনের সম্ভাবনা এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে নব্বই …শূন্য …তৎপরবর্তী অনেক কবির মধ্যে …এই গন্তব্যহীন ব্যতিক্রমের পুনরাবিষ্কারে …শব্দের নিজস্ব আলোর চলাচলে …আর এই সমস্তটাকে আত্মসাৎ করে যে অসম্ভব কবিতার জন্ম ,যা অনেকের মধ্যে শুরু হয়েছিলো আন্ডারগ্রাউন্ডে জিপসিদের তাঁবুর ভেতর গলে যাওয়া মোমের আলোয় তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে আজ শত প্রযুক্তির হাত ধরে নতুন নতুন কবিদের মধ্যে …কবিতা যাবতীয় শূন্যপূরণের শর্তকে মাথায় রেখে কবিকে অজানা শব্দ নিখিলের বিমূর্ত অভিলাসায় চুরমার করে দেয় …কবি যখন অন্যের এঁটো করা খাবারে মুখ ডুবাতে চায় না ,স্বস্তি চায় না ,ভিখিরির মতো ছদ্ম ও মেকী মুখোশ পরে কেবল কবিতা লেখা নৌটাঙ্কিপনা দেখিয়ে পুরস্কার আর বাইরের প্রাপ্তির জন্য অভিসন্ধিপরায়ণ হয়ে হেদিয়ে মরে …শত সহস্র শেকলে বাঁধা পড়ে হারায় তার কবিতা লেখার মানষিক স্বাতন্ত্র ও লেখার মন …কবি কী চাইবে ?বাইরের মুহূর্ত প্রাপ্তি না ভেতরের দিকদিশাহারা মুক্তি ?

অনিন্দ্য: আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি, সেই নব্বইয়ের হইচই,  আজ তুমি সেই সময়টাকে , সেই সময়ের কবিতাকে কীভাবে দেখো, কীভাবে ফিরে দেখো?
 প্রদীপ :  নব্বই দশক এমন এক অভূতপূর্ব দশক ,গত একশ বছরের সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থার যাবতীয় রূপান্তর অবস্থান প্রাধান্য ও পরিবর্তনের অন্তর্গত অর্থনীতি কি ব্যক্তি মূল্যবোধ কি সম্পর্ক ভাঙনের বা দেশ কালের ব্যবধান ও বিস্তার …ব্যক্তিচেতনার আণবিক কেওস ও নানা বিচিত্র সম্ভবনার সময়ান্তরের শ্রেষ্ট -নিকৃষ্ট -প্রগতি ও তার পরিপন্থী ভালো মন্দের এক প্রসারিত মানবৃত্ত …এক ঝটকায় এই দশক গত একশ বছরের যাবতীয় দ্বন্ধ ও সিদ্ধান্ত কে নতুন পথে উড়িয়ে নিয়ে গেছে
: নব্বই এর যুবক কখনোই না পুরো পোস্ট কলোনিয়াল না পুরো অর্থডক্স বা পুরনো মূল্যবোধের পেটেন্ট ভ্যালুতে চলা …তার সত্তা বহুমুখী …তার ডিসকোর্স শুরু হয় না কখনোই মেধা শ্রমিক বা নিছক মেধা পশু হিসেবে …
তার পরীক্ষিত রবীন্দ্রনাথ ,কলকাতার অলি গলিতে ঘোরা সুতীর্থ বা মাল্যবান কখন যেন হিম জীবনানন্দের সংগে মিশে যায় ….ডোভার লেনে রাত জাগা দুটো চোখ গান শোনে বড়ে গুলাম …গ্রামোফোন -এর কুকুর চোঙ্গা থেকে গেয়ে ওঠেন হেমন্ত মান্না কিশোর শ্যামল মানবেন্দ্র সতীনাথ অখিলবন্ধু আরো অনেক সাড়ে চুয়াত্তরের দল
নব্বই মানে ,যাদের কিশোর বেলা আশির দশক …সাদা কালো বক্স টিভি …দূরদর্শন …ছ ব্যাটারীর রেডিও …অনুরোধের আসর …ঊনো জমির দুনো ফসল …গল্প দাদুর আসর ও পার্থ ঘোষ …মহিলা মহল …শিশু মহল …ইন্দিরাদি …বেলা দের রান্না …দেদার কব্জি ডুবিয়ে ছুটির রোববারে পাঁঠার ঝোল আর ভাত …ভাত ঘুম …বোরোলিনের সংসারে আদুরে ন্যাকা ন্যাকা গলায় দুষ্টু মিষ্টি শ্রাবন্তী মজুমদার …
আমিন সহানি ও বিনাকা গীতমালা
: পুরনো সিনেমা হল …ম্যটিনি সো …নুন সো …পুলিশ আর ব্ল্যাকারের সহাবস্থান …
রেডিওয়,স্থানীয় সংবাদ ,বরুণ মজুমদার ,দেবদুলাল ,তরুণ চক্রবর্তী ,নীলিমা সান্যাল …দুপুরের নাটকে জগন্নাথ বসু ,শুক্লা বন্দোপাধ্যায় ,বিকাশ রায় ,শোভনলাল মুখার্জী ,শম্ভু মিত্র ,তৃপ্তি মিত্র ,রুদ্রপ্রসাদ …আরো অনেকে ….
নব্বই এ তখনও বেঁচে ইস্টবেঙ্গল …মোহন বাগান …কি জীবন্ত ইলিশ চিংড়ি!…ক্লাব ফুটবল ..
নব্বই এ আছে গ্রাম বাংলা কাঁপানো মাচা শো …যাত্রা …নটটো কোম্পানি …অগ্রগামী …শুরু হতে চলেছে নিউ কমার্শিয়াল ইয়োথ কালচার -এর ধরতাই …আটো -শাঁটো প্যাণ্ট বা বেলবটম ,সাইকেডেলিক শার্ট ,ঝাঁকড়া বাবরি চুল বা সত্তর দশকের লম্বা জুলপি ,জলদস্যুসুলভ গোঁফবিন্যাস ,বিচিত্র বর্ণের অভূতপূর্ব প্রগল্ভ পোষাক ,মাদক বড়ি থেকে মারিজুয়ানা …একদিকে মনন অন্য দিকে মননহীন মানুষের অনুকরণসর্বস্বতা -চিন্তা চেতনায় ও আচরণে মৌলিকতা ক্রমশ অদৃশ্য হবার প্রস্তুতি …

বাঙ্গালী ও প্রতিবাদ …ক্যাপিটালিজম আর কলোনিয়ালিজম নিয়ে কার্টুন থেকে গণনাট্য নিয়ে মার্ক্সবাদ থেকে ম্যাজিকরিয়ালিটি নিয়ে …একদিকে নেলসন ম্যান্ডেলা অন্যদিকে সৌরভ -শচীন বা একদিকে পোয়েনজিত …তাপস …রঞ্জিত …অঞ্জন চৌধুরী …হরনাথ …স্বপন সাহা …অন্য দিকে আঁতেল কফি হাউস কাঁপানো নব্বই এর কবি কিছুটা বুনুয়েল ,কিছু কিছু আন্তনিওনি ,কুরোশাওয়া,ক্রফো,আইজেনস্টইন ,বার্গম্যান ,ফেলিনি ,গদার ,সত্যজিৎ,মৃণাল ,ঋত্বিক ,তরুণ ,তপন সিনহা …
: মাঝখানে প্রলেতারিয়েত থেকে প্রযুক্তি বিজ্ঞান …দেশীয়তা বজায় রেখেই এক বিদেশি বিপন্নতা …
নব্বইএর যুবকের হাতে নতুন নতুন ভোগ্যপণ্যের দিক দিশাহীন খুলে যাওয়া নিষিদ্ধ জগৎ …একদিকে মিশেল ফুকো দেরিদা গ্রামসি ও লালন অন্যদিকে অ্যালিয়েনেশন এফ এম চ্যাটিং কিংবা জীবনমুখী গান …সুমন নচিকেতা অঞ্জন আবার বছর কুড়ি পরে ফিরে আসা মহীনের ঘোড়াগুলি …: এর মধ্যেই অনিবার্য ভাবে অন্দর -বাহিরে এসে পরে স্ববিরোধ ইতিহাসের বাঙ্গালী উদ্বাস্তু ..যার সমস্যা ভুগেছে আমার বাবা মার মতো অনেকের বাবা মা …ভুগেছেন ঋত্বিক ঘটক …বিকল্প পরিবার ও বিশ্বায়নের জোর ধাক্কা …
এর মধ্যেই এলো মনমোহনের উদার অর্থনীতি …সুনামির মতো খুলে গেলো ওপেন মার্কেট ভ্যালু …চীন আরো গুছিয়ে বাজার দখল করলো …ভারতীয় তথ্য প্রযুক্তি আর মানব সম্পদ পেলো নয়া দিশা …এটাই বিকেন্দ্রীকরণ ও বিদেশি আরেক রূপ …
: জীবনের সব কিছুতে ঘটলো নব সংকরায়নের এক জগা খিচুড়ির অবস্থা …বহু চাকরির পথ যেমন বন্ধ হলো ,তেমনি পরোক্ষ বেসরকারীকরণ খুলে দিলো নতুন job concept … তল থেকে দেখা ইতিহাসের ডায়াস্পোরা…তুমি তো এ নিয়ে দুরন্ত একটা লেখা শুরু করেছো
কবিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা সবচে আমার মনে হয়েছে সেটা হলো এই দশকের একটা প্লাস impact একটা সুদূর প্রসারী সত্যির সফল উন্মোচন
: বাংলা কবিতা তার কলকাতামুখী রাজপথের বিলাস ভ্রমণ ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে …মফস্বল সেমি টাউন শহর নগরের উপকণ্ঠ থেকে অলিতে গলিতে …যতদিন রবীন্দ্র স্নেহধন্য মানি সম্পাদক বেঁচে ছিলেন যতদিন পঞ্চাশের সোনার হরিণ শিকারী কবিদের হাতে ছিলো প্রচার সর্বস্ব পত্রিকার চাবি তখনও কিছুটা হয়তো তার গুণমান ছিলো …কিন্তু নব্বইয়ে এসে ইতর প্রাণীর বিষ্ঠা চটকানোর ইচ্ছে চলে গেলো কতিপয় তরুণদের মধ্যে থেকে …তখনও নব্বইয়ের বহু অবুঝ কবি “গোঁসাই কীর্তনে”মেতে আছে ,বই মেলা চত্তরে ঢোল কত্তাল সহ …তবে তাতে কি ?অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?…সে তো পূর্বতন সরকারের আমলে ও কেবল বামপন্থী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী কবিদের প্রতিবাদী কবিতাই ঠাঁই পেয়েছে সিলেবাসে ,এখন ও সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে ,চেয়ারমোছা কবির কবিতা ঠাঁই পায় পাঠক্রমে ..
ওই ওপর চালাকি ভরা দিক দিশাহীন কবি কুলের অবস্থান বদলায়নি দশক ফেরে …কিন্তু আমূল বদলেছে পাশাপশি সমান্তরাল ধারার কবিতা ভুবন
এ ব্যাপারে মনে পড়ে কবিতা পাক্ষিক ও প্রভাত চৌধুরীর অবিস্মরণীয় ভূমিকা …সফল ট্রেড ইউনিয়নের দরদী নেতার মতো শ্রেষ্ঠ সংগঠক রসিক রন্ধনক্রিয়ায় দক্ষ ,ব্যতিক্রমী কবি প্রভাত দা এক ঝটকায় গ্রাম মফস্বল শহরে কবিতাকে অন্য ধারার কবিতাকে ছড়িয়ে দিলেন …উঠে এলো অজস্র তরুণ কবি …
পাশাপশি বাঁকুড়া থেকে কবিতা দশদিন নাট মন্দির দূর্গাপুর থেকে কুরুক্ষেত্র বিষ্ণুপুর থেকে সমাকৃতি নতুন করে বর্ধমান থেকে বাল্মীকি ,পানাগড় থেকে স্বকাল ,জলপাইগুড়ি থেকে এরকা ,জামশেদপুরের কৌরব তো ছিলোই আগে থেকে …পাশাপশি বনগাঁ থেকে মুহূর্ত ,মেদেনীপুর থেকে ছিলো অমৃতলোক ,মুর্শিদাবাদ থেকে ছিলো রৌরব আগে থেকেই …কতো বলবো !…

রূপনারায়ণপুরের বোধ ও অরুণদা ,বড় ভূমিকা পালন করেছেন নব্বই এর তরুণ কবিদের জন্য
এই সমস্ত পত্রিকা আয়তনে ছোটো হলেও ,কলকাতার বাইরের তরুণদের জন্য আত্মবিশ্বাস -এর একটা প্লাটফর্ম তৈরী করেছিলো সেই সময় …
বঙ্গ কবিতার ইতিহাসের ধারা অসম্পূর্ণ থাকবে ,যদি না কলকাতার বাইরের কবি ও পত্রিকাগুলো নিয়ে কাজ না হয় …কিন্তু দুঃখের ব্যাপার ,প্রচার মাধ্যমের পদলেহী ,সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেনা মুনিম কা চামচে ,গোলাম গবেষক রা অসম্পূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ লিখে হালে পানি পায় …
: পায় পুরস্কার আর ডিগ্রি …!হা হা …
তবে অন্য ব্যাপারের মতো নব্বই এর কবিতাতেও প্রচুর পরস্পর বিরোধী ঘটনা ….যেমন দেখো
পঞ্চাশ আর ৬০দশকের দুটো নেতি ও ইতিবাচক প্রভাব নব্বই এর কবিতায় পড়েছে …পঞ্চাশের আত্মআবিষ্কারের খেলা ,চূড়ান্ত সচেতন কিছু গিমিক ,কিছু ভোগবাদ ,কিছু চমকপ্রদ পঙ্‌ক্তি …কবিতা সচেতন নির্মাণ নয় পুরোটাই ট্রান্স …পুরোটাই রহস্যের আড়াল …কবিতা লেখা হয় না পাওয়া হয় …এই এক,ধারণা …কবিরা কবিতার চেয়ে কবির সেলেব্রিটির মতন এক কুহক যাপনকে বড় করে দেখালো …কবির বেঁচে থাকার ধরন ,কবির মাতলামি ,কবির প্রচার ,কবির দাদাসুলভ অতিমানবীয় আচরণ যাতে পাঠকের নজরে পড়ে ,সেটাই অনেক কবি চাইলেন …কবি চাইলেন ভক্ত ,নিছক পাঠকে তার মন ভরলো না …সবাই কবি নন …কেও কেও কবি …অর্থাৎ এক অসম্ভবের আড়াল তৈরি করলেন  নির্দিষ্ট সীমা এঁকে দিলেন …পাঠক আর কবির মাঝখানে এঁকে দিলেন সমূহ আড়াল …কবি যে নিছক আর দশটা মানুষের মতো সাদা কালো …এটার বিরুদ্ধে গেলেন কতিপয় কবি …প্রচার মাধ্যম লুফে নিলো এই সমস্ত কবিদের মনোভাব …ভাবলে অবাক লাগে ,পঞ্চাশের কিছু কবিদের মনোভাবকে উস্কে দিয়েছিলেন পরোক্ষে ,তিরিশের এক জন খুব বড়মাপের শক্তিশালী কবি ও গদ্যকার আর নব্বই এর কিছু কবি ,কবিতা লেখার চেয়ে সেই মনোভাবের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ল বেশি …বলতে দ্বিধা নেই …নব্বইয়ের অনেকই সুনীল শক্তি বিনয়ের জীবনযাপনে ভক্ত হয়ে গেলো …তারা এটা বুঝতে চাইলোই না ,যে এক জন সুনীল একজন বিনয় একজন শক্তি এভাবে তৈরী হন না …নব্বই এর অনেকেই তাদের বাইরের যাপনকে কবিতা মনে করলো …বুঝলো না ওই সমস্ত বড় মাপের প্রতিভা কেবল গিমিকে বড়ো হননি …এর ফলে অনেক নব্বই এর কবি মাখো মাখো তিন নকলের আসল খাস্তা অনুকরণসর্বস্ব বস্তাপঁচা কবিতা সাপ্লাই করতে থাকলো …এতে না হলো কবিতার উপকার ,না হলো কতিপয় পাঠকের ….প্রচার প্রচার আর প্রচার …কেবল ছকবাজী কেবল লবিবাজী কেবল সংবাদ পত্রে চাকরি করে কবিতাকে জীবিকা করার দায়ে ভেসে গেলো নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার ভাবনা …একজন মণীন্দ্র গুপ্ত ,একজন রমেন্দ্রকুমার একজন দেবদাস আচার্য্য একজন রঞ্জিত সিংহ একজন দেবীপ্রসাদ একজন কেদার ভাদুড়ি…এভাবে কী তৈরী হয় ?
আবার অন্য দিকে ৬০এর কিছু বিদেশে বাতিল আন্দোলন বিরাট প্রভাব ফেললো কয়েক জন নব্বই এর কবির মধ্যে …তারা অন্তত এটুকু বুঝলো ,গত শতাব্দীর যে মনোভাব …খুব খুবই বড়ো মাপের প্রতিভা যারা শতাব্দীজুড়ে রাজত্ব করেছেন কবিতায় ,সেই সময় আর ফিরবার নয় …সময় বদলেছে …সদর্থক ভাবেই আমরা যেমন আমাদের ইতিহাসের দিকে গর্বের সংগে তাকাই …তাকে অনুকরণ করি না ভুলেও …সেভাবেই বর্তমান কবিতার জগত হবে ছোটো ছোটো গোষ্ঠীতে বিভক্ত …সদর্থক ভাবেই পাঠক কমবে …যদি নিন্দুকেরা বলেনও ,এরা পরস্পরের পিঠ চুলকে যাচ্ছে …ওকে …মানতে বাঁধা নেই বড়ো প্রতিভা আর পৃথিবীতে আসবে না ….যখন বাংলা ভাষার দুর্দিন …এমন এক সময়ে আমরা আছি ,সমস্ত পৃথিবীর উন্নয়ন ধরা আছে পকেটের স্মার্ট ফোনে …মাল্টি মিডিয়া মাল্টিপ্লেক্স ,কি গান কি কবিতা ,কি ছবির জগৎ আর ভবিষ্যৎ-এ কারোর ,বলতে বহু জাতিক মালিকের হাতে আর থাকবে না: মানুষ ইচ্ছে মতো পড়বে বা তার নিজস্ব বিনোদন বেছে নেবে …অন্তত সোশ্যাল মিডিয়া এটাই প্রমাণ করছে আজ …সেখানে কবি তার পাঠক -বন্ধু তৈরী করবে সে নিজে …তার পরিচিত পাঠকের বদলে অচেনা পাঠক তার কাছে সন্দেহের মনে হবে …এটা কিছু নব্বই এর কবি বুঝেছিলেন …
তাই সে তার কবিতার বই সে নিজে তৈরী করবে …তার পাঠককে  সে এমনি দেবে বই …পাঠক সরাসরি তার খারাপ ভালো লাগা জানাবে কবিকে …নব্বই এর নিরীক্ষা মূলক কবিতায় বিশ্বাসী কবিকে,কতিপয়  এসমস্ত কবি কে প্রেরণা জুগিয়েছিল কিন্তু ৬০এর এই কবিতা আন্দোলনগুলো …এই আন্দোলনের পরোক্ষ সার্থকতা কিন্তু ৮০আর নব্বই এর এই সমস্ত কতিপয় কবির কবিতা

: পার্থক্য হলো এই নব্বই এর এই সমস্ত কবি জানেন তারা বড়ো বাড়ির চেন বাঁধা সারমেয় নন …তারা স্বাধীন …তাদের কোন স্টেক নেই …তারা ভালোকরেই জানেন অমরত্ব একটা সভ্য সমাজের অলীক অবৈজ্ঞানিক বুজরুকি …যতদিন কবির চেতনা নিঃসঙ্গ করে বাঁচিয়ে রাখবে তাকে …জন্মের আগেও শূন্য …মৃত্যুর পরেও শূন্য …সবার অজান্তে এসে সবার অজান্তে থেকে সবার অজান্তে স্পট লাইটের আলো ছাড়া এই ভ্রমণ …চলে যাওয়া …
মৃত্যুই এক মাত্র সত্য ও অমর …জীবন ক্ষানিকের …এই জন্যই বেঁচে থাকা মূল্যবান …কবিতাও …এক মাত্র চেতনার অক্সিজেন…যাবতীয় ন্যাকা চাহিদা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের কবিতার স্বাধীন পরীক্ষাই এই সমস্ত কবির প্রেরণা …নিজের ভাবনা আর কাল্পনিক অভিজ্ঞতাকে নিজের মতো করে বলতে গেলে ,যে ভাবে যে ভাষায় বলতে হবে কবিতা টু কবিতা সে ভাবেই বলবেন কতিপয় অন্য ধারার নব্বই এর কবি …তার জন্য ভাষার শব্দের জাহান্নাম থেকে নরকে সে যেতে পারে …এটাই তার ও তার কবিতার মুক্তি …এটুকুই বলার নব্বই এর কবিতা ও সময় নিয়ে
অনিন্দ্য:  ‘রেনবো গ্যালারিনী’ থেকে তোমার যে কবিতা,  যে অনির্দেশে যাত্রা, ‘ ছাতিম হরবোলা’ , ‘ সুফিরং’, ধ্বনি ও বর্ণের যে ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া তুমি রেখেছ আমাদের সামনে, এই যে সবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া,  আলাদা হয়ে যাওয়ার মুদ্রাদোষ,  কী মনে হয় আজ, কবিতা কতটা ধ্বংস করল তোমাকে?  কতটা উস্কে দিল প্রদীপের সলতেটি?
 প্রদীপ: সেই কবেকার বালক বেলা থেকে অনুভব করেছি দুটো জিনিস …পৃথিবীর কোন ব্যক্তি সত্তার সঙ্গে আমার কখনো মিলবে না …আর আত্মজীবনী কেও কোনদিন লিখতে পারে না …এই কথা শুনে হয়তো রে রে করে ছুটে আসবে পাঠক …এবং উদাহরণ হিসেবে সে হয়তো একশো একটি উদাহরণ দেবে …আমিও কিছু কিছু জানি সে উদাহরণ …তবু আবার একই কথা বলবো আত্মজীবনী লেখা যায় না …লেখক তার অসাধারণ লেখায় তার নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে খন্ডাংশ পাঠককে উপহার দেন …তার ভাষার চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে সীমা শেষ হারা লেখার অসীমতা হয়তো কয়েক দশক আর শতাব্দীতে ,পাঠকের অনুভবে  তাজা আলো ছায়ার অবর্ণনীয় রহস্যে কোন অস্থির প্রণোদনায় হয়তো জেগে ওঠে …তবু কবিতা লেখক জানেন ঠিকই ,সক্রিয় মানুষের সভ্যতা ও মানুষহীন অবিরাম সময়ের মধ্যে তার অসমাপ্ত জীবন আর তার অপ্রস্তুত মুখ ,তাকেই বারংবার ভেংচি কাটে …সে অভিশপ্ত …কারণ সে একা …সে কারোর সংগেই মানাতে পারে না …তাকে উপেক্ষা করেই সমাজ এগোয় …সভ্যতা এগোয় …তার বন্ধু বান্ধব দারা পরিবার এগোয় …সে উপাধী পায় পাগল ও অহংকারী বলে …সমাজ তাকে আপদের স্বীকৃতি দেয় …তারপর সে যদি কোন পুরস্কার তিরস্কার প্রচারিত পত্রিকা ও কাগজে কোন কল্কে না পায় ,তাহলে তো পোয়া বার …সে কেউ নয় …এক নিরীহ ঢ্যামনার দলে অসংখ্য ভিড়ের ভেতরে সে আরো আড়ালের প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়
: আর সেটাই মজার …আমি প্রথমাবধী এই একার জীবনটাকে পুরস্কার বলে মেনে এসেছি …আর দিনে দিনে বাইরের আচরণ স্বাভাবিক রেখে একটু একটু করে মানুষের থেকে দূরে সরে গেছি …এতো গাছ ,এতো রঙ ,এতো আলো এতো পশু পাখি সারমেয় এতো নতুন নতুন পথের বাঁক ,এতো মিশ্রিত হারমোনিকস এতো সুরের প্রতিসুর এতো স্বরের প্রতিস্বর কোন মাচা বোর্ড ক্লাস রুমের বাইরে এই যে মুখর ডুবে থাকা মানুষের বাইরে বন মর্মর এতো পরিচিত বিলাস বৈভব তৈজস -এর বাইরের জীবন আমাকে টানতে থাকলো চিরটাকাল …
আমি ক্লাস পালানো ছেলে ছোটো বেলা থেকে …আমি পাস করে করে বুঝেছি ,পৃথিবীতে সব চেয়ে সহজ কতো গুলো ডিগ্রি আর পরীক্ষা পাস …সবচে কঠিন নিজের প্রতিটি অনুভবকে ঠিক ঠাক চিনে ,নিজের লিমিটেশন বুঝে নিজের বোধের জগৎকে শেকল ছাড়া করা …পৃথিবী জন্মাবধি দেখে এলাম এক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান …মানুষ প্রতিদিন শত তুচ্ছতার গ্লানি কে গৌরব মনে করে সময় কাটিয়ে গেলো …চেতনায় চির পরিবর্তনশীল সর্বব্যাপী লুপ্ত এক রোমাঞ্চিত খেলা ও খেলা ঘরকে দেখতেই চাইলো না …
যেহেতু মানুষ সমস্ত কিছুরই বিনিময় চায় …কবিতাকেও অনেকে সে ভাবেই দেখতে ভালবাসে …এতো পার্থিব চাওয়া শেষে খেই হারিয়ে ফেলে …তার কবিতা বুঝতেই  পারে না ,এই বিষয়ী বাবুটির কবিতা কীভাবে অবিষয়ী ,আশয় মুক্ত হবে …
????….!!!

আর সেই চাওয়া হীন নিঃশর্ত আনন্দ …সেই অবিষয়ী বিষাদ …সেই জগতব্যাপী অপ্রত্যাশিত পেয় আমি হঠাৎ হাতের কাছে পেয়ে যাই অনাসক্ত নির্লিপ্তর নৌকো বেয়ে বেয়ে …নিজেকে বাজাই নিজেকে পোড়াই নিজেকে নিঃশব্দ পরিব্যাপ্ত উদাসী ছায়ার অংশভাগ করে করে নিজের আমিকে মিলিয়ে দিই ….জড় ও জীবের অবিমিশ্র অব্যক্ত-এর আদি উৎসে …
প্রাচীন কালের ছায়ামাখা নিসর্গের ক্রম পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে দেখতে থাকি প্রতিটি প্রাণী বস্তু ব্যক্তি জীব আপাত জড়ের ছদ্মবেশে পাথর ও পাহাড় কতো রঙ গন্ধ স্পর্শ বর্ণ ধ্বনি পাখি  তাদের সঙ্গে আমার সূক্ষ সম্পর্ক ও ফিরতি আদান প্রদান …
: কী দেখছি না …কীভাবে দেখছি …কিংবা যেভাবে ভাবে সবাই ,তার সম্পূর্ণ ১৮০ডিগ্রী বিপ্রতীপে গিয়ে একটা ভাবনা কে নিয়ে শব্দে খেলতে গিয়ে ,সেই উত্তুঙ্গ তীব্রতায় লেখা কাটা লেখা কাটার মধ্যে দিয়ে শব্দের সম্ভাবনার জাহান্নামে গিয়ে তার শেষ দেখার ইচ্ছে আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে …আমি চির অতৃপ্ত …সবসময় মনে হয় ধুস ….হলো না লেখাটা কিছুই
: কতো মধ্য রাত ,অসঙ্গ খেলা …সংসার পৃথিবী …পাতা ঝরা …টোবানো শিশির …ক্ষণরৌদ্রের মধ্যে ডাকাতের মতো চলে যাওয়া শব্দের পর শব্দ …যে শব্দের জন্য আমি হন্যে হয়ে খুঁজেছি ৫০০বছর আগেকার তুলোট কাগজে লেখা পুঁথি …পুরনো অতি ব্যবহৃত শব্দের পাশে বসিয়েছি প্রয়োজন মতো ধ্বনি কে কগনিটিভ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে একটা কেওটিক অবস্থায় …কাড়া আকাড়া দেশী বিদেশি  তৎসম তৎভব জোড়শব্দ হাজার বিমূর্তগুলোর স্বপ্ন -ইশারা …
এই গীতল ছন্দস্পন্দিত শ্রুতিমধুর এবং একমাত্রিক কবিতা যা গরিষ্ঠ-এর ঈপ্সিত লক্ষ্য ,তার নিরক্ত বিযুক্তি তার প্রথাগত আর্তনাদ …আমায় পাগল করে দেয় …আমি এর সর্বতোভাবে চির বিরোধী …এই কবিতা আমার চলার শত্রু এই লজ্জাবতী লতার মতো শিহরনময় লিরিক তারল্য আমি চাই না ..চাইনি ..অতিকথনের গপ্পো গাছা চাই না …চেয়েছি একটা স্পার্ক একটা চকিত আভাসে পাশাপশি দুটো সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ শব্দ বসিয়ে ভাবনার জড়তাকে এক ঝটকায় কাটিয়ে জড় ও জীবের সম্পর্কের নিশব্দতায় চলাচল ঘটিয়ে এক সমূহ প্রাণের আলো রেখা অসীমে ছড়িয়ে দিতে …চেয়েছি সে ভাবে খেলতে …পারিনি হয়তো কিছুই
: যাই হোক এ নিয়ে নিজের মুখে বেশি কথা বলে কিই বা হবে ?…যদি কেউ কখনো আমার কবিতা পড়েন ,তার অনুভবের মিথস্ক্রিয়াই বলে দেবে ,আমার কবিতা আদৌ পাঠযোগ্য কি না ?…শেষে আমি আমার সুফি রঙ কবিতার বই এর ভূমিকাহীন প্রারম্ভে যা বলেছিলাম ,সেটাই আরেকবার তুলে দিলাম এখানে ..

“:মোনের অবিকল প্রবাহবিন্দুকে জগতের চাপ ও প্রবাহ একাকার ক’রে দেখি আর বুঝি তার রং বাস্তুহারা। যেখানে রঙ নিরবধি সেখানে অবয়ব অব্যর্থ হয়েও ভেদ ক’রে স্তম্ভ, শীর্ষনবিন্দু এবং জনমানবহীন অসম্ভব বেঁচে থাকার চক্রগ্রন্থি ..কতো অক্টোপাস-হাঙ্গর- চুনোপুটি, কতো খড়মড়ে হাড়ের পাশা,প্রকান্ড প্রকান্ড ঢেউ….সমস্ত কিছু তলিয়ে যাচ্ছে আর একের পর এক চোখ বুজে লাফ দিতে গিয়ে দেখছি হাতমুঠো করলেও কুয়াশা এমনকি হাত খুললেও!  কেবল অলীক…শূন্য…ভৌম নীল…পলকের বৃষ্টি…পলকের আভাসে বিলীণ রাগ রং হৃদি …এত তরং,কুহর…এত রুদ্রশোণিতে চলে

কথা বলতে চাই নিজের ভাষায়। কিন্তু ভাষা কোথায়? আজ শুধু অস্পষ্ট সুদূর এক মুখ মনে পড়ে। এত আনাড়ি অনুভূতি। এত এলোমেলো । সহসা আসে। সহসাই চলে যায়।  একটারর পর একটা শব্দ একটানা বেজে জাচ্ছেশেশ পর্যন্ত আমি তার কাছে কেবল একটি খন্ডিত অংশ ছাড়া কিছুই নই ,সেই অবিশ্বাসী সেটাই প্রমাণ করে।বুঝিনি কখনো, আসলে আমি কি লিখতে চাই! আবহমান না নতুন না পুরনো না বিকল্প না সমান্তরাল ।অপরাপর বুঝিনি । সেভাবে আয়ত্ত ও করি নি দক্ষ কবি’র মন্ত্রমুগ্ধ ক্ষমতা । বুঝি নি সেভাবে, সিঁদকাঠি হাতে নিয়ে কোন্‌ কবিতা কোন্‌ বিজনে ঝরাতে থাকে এই জন্মের একটু একটু বিষয়। আর তার অ্য্যানাসথিসিয়া প্রয়োগে পাঠকের আনন্দ আরও এক পঞ্চম অবস্থায় পৌঁছয়।মানে বুঝি নি। বুঝিনি ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য শাওন আকাশে সুন্দ্রী মেঘের ঘনঘটা, অস্থির সমালচকের চকিত বিদ্যুৎ, উচ্ছ্বসিত যমুনা পুলীন… আমারও মতো আপাংক্তেয়র ভাবনাচর্চা বা উপলব্ধি কোন্‌ দশক বৃত্তে আটকে আছে তাহলে

চেয়েছি বারংবার খাঁচাটাকে ভাঙতে । খাঁচার শ্রেণিচরিত্র ভাঙতে। খাঁচারও   শ্রেণিচরিত্র! হায়! হায় তোতা! হায়! তার অমসৃণ উড়৳আল। ফরফর ক’রে আটকে গেছে তার ডানা ঝাপটানি। ডানার কসরৎ !তবুও তাও পুলক আর ব্যথা যুগ্ম চরিত্র হয়ে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে গেছে অনেকদিন। দূরে থাকা। চোখে চোখে থাকা। নিরুত্তর ভালবাসায় তাকা। ছিঁড়তে কুড়োতে গন্ধ নিতে নিতে থাকা। মনে পড়ে স্তব্ধতা, পরিকল্পনা আর তাদের শান্ত বিক্ষিপ্ত মুখ। তবুও তো একজন মানুষ নিজেকে খুলতে চায়।সহজ সব কাঁটা আর শল্ক উপড়ে ফেলতে ফেলতে খুবসহজেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুধু একজন মানুষ তারপরেও নিত্য নতুন বাহানায় এক ঘেয়ে,গতানুগতিক বেঁচে ত্থাকার ভেতর বাঁচতে বাঁচতে খোঁজে নিজের থেকেও নিজের গোপন আড়ালটুকু। কাঙালের মতো খুঁজতে খুঁজতে একদিন পরিত্যক্ত ছো্ট নিচু অলক্ষ্যে আগুপিছু মুছতে থাকে নিজেকে। মুছতে থাকে নিজের আলোবাতাসহীন মাথার নষ্ট হয়ে যাওয়া নিন্দুককে । শীতে অকালবৃষ্টিতে, হু হু বাতাসে ফেলে রাখা খড়কুটোর মতো সামান্য এই শব্দের সমস্ত শরীর।করে জেন বৃষ্টি হয়েছিল। কবে জেন কৃতকর্মের ভারে অপরাধীর মতো বলেছিল , তোমরা কত শান্ত-সুন্দর আর পবিত্র … হে পাঠক … হে তথাগত …”

এক প্রান্তিক শিল্প শহরে বড় হতে হতে আজ মাঝ বয়সে দেখি আজও পলাশ শিমুল বনে খুন খারাপির দাগ মন উচাটন করে …এক বিদায়ী সময়ের চিহ্ন তার আঁচড় দাগ নিয়ে লিখতে এসেছিলাম …যে সময় ফুরিয়েছে আর আসবে না ,সীমান্তের কাঁটাতারের এক দিকে এক পা অন্য দিকে অজানিত ভবিষ্যৎ …যখন মানুষের সম্পর্ক প্রতিদিন ভাঙছে …অ্যারোগানট মানুষ যখন তার নিঃসঙ্গতায় ডুবে সারোগেসির দৌলতে গর্ভ ভাড়া করে জন্ম দিচ্ছে নতুন শিশুকে …সেই শিশু ,তৃতীয় বিশ্বের সেই অভাবী মা ,শুকিয়ে যাওয়া চোখের জল …আর একা ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মানুষের রণক্লান্ত জীবনের রোগ ভোগ …এসবই ভাবায় আজ কাল খুব …সম্পর্কহীন মানুষ তার অসহায় অবস্থা ..দূষণে ক্লান্ত নিসর্গ …আর অসংখ্য পশু পাখী তাদের নীরব প্রতিবাদ হয়তো এখন আমার কবিতার অনুভব …
অনিন্দ্যঃ আমরা আশাবাদী,  প্রদীপ, বাংলা কবিতা,  বিভিন্ন ধারায় পুষ্ট হবে আগামী দিনেও।
আগামীর কবিতা একটা হাইপোথিটিক্যাল ব্যাপার যদিও, তবু, তোমার আগামীর ভাবনা কিছু বলবে?
 প্রদীপ : While in the daytime birds always look as if they are flying about aimlessly, in the evening they always seem to find a destination again. They fly towards something. Also perhaps in the evening of life …
Is there an evening of life?
: Albert Camus এঁর ডায়রী ,আমি বারংবার পড়ি …আর এই অংশটায় এসে আমি কেমন যেন থমকে যাই …আজ আবারও তোমার প্রশ্নে এখানে থমকে গেলাম …
: আগামীর ভাবনা …আমার …?কোন্ আগামী ?যেখানে পাখি নিরবধি কাল ধরে বাসায় ফিরতে ফিরতে কি আর ফিরবে …? ফিরবে না সে কী ফিরবে না ..ফিরবে না আর কোনদিন …!কোন্ পাখি ?নীড় কোথায় ?সন্ধার কোন মেঘমালায় ?
এই অনির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে …স্রোতের বিরুদ্ধে গোড়ালি চেপে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আদ্যন্ত সংশয়াছন্ন মানুষ ,এক কবন্ধ সময়ের আয়নার মুখোমুখি …গত আর শুরু হওয়া নতুন শতকের প্রায় দু দশক শেষ হওয়ার  মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে আজ এই সমসাময়িককালের তীব্র বিছিন্নতাবোধে অসহায় লাগে মাঝে মাঝে
কোন সময়ের কবিতা ? যখন আত্মক্ষয়কারী মানুষের অনিকেত যাত্রায় মুখোশের লুকোনো সাংকেতিত নিঃসহায়টুকু ছাড়া কিছু নেই …!
:আমি দেখি প্রতিদিন কিভাবে বদলে যাচ্ছে  সমস্তকিছু দ্রুত …বাইরের বিস্তার জুড়ে নারীর একাকীত্ব আর ঘরের নির্বিকল্প ঘেরে নতুন সময়ের পুরুষের একাকীত্ব …অনেকটা আমাদের অবস্থা এখন ঠিক সেই মজদুরটার মতো ,বস্তারের গ্রাম থেকে যে আজ গিয়ে ঠেকেছে মুম্বই এর ধারাভির চাউলে,কিংবা কলকাতার ছকু খানসামা লেন থেকে যার দৌড় গিয়ে থেমেছে ম্যানহাটনের স্কাইস্ক্র্যাপারে -এক অর্থে তারা সবাই বিশ্বজোড়া অভিবাসী সমাজের নাগরিক …যাদের এক পা স্মৃতিতে ,এক পা বাস্তবে …সোজা কথায় ,না -ঘরকা ,না -ঘাটকা …আমাকে খুব ভাবায় গো

: তুমি যদি আমার কবিতা প্রথম থেকে লক্ষ্য করো ,তাহলে দেখবে আমার ক্যানভাস তার প্রতি মুহূর্তে বদলে যাওয়া চলমানতায় ,রঙ-এ , তার বিশাল বিষয়হীন বিষয়ের বিস্তারে ,অপ্রচলিত বুকের মরশুমে মরশুমে ঝরে যায় পৃথিবীর শেষ খরগোসের মতো …অকায়িক নিশব্দে রূপের মেঠো ঘাম ,রসের ফাটা চামড়া গন্ধের রুক্ষ বাকল স্পর্শের অসীম জা ড্ড্যে আমি ই হয়ে উঠি পৃথিবী পাড়ের দেশ …এর ফলে আমার কবিতা বাঁকে বাঁকে আমাকে ছাপিয়ে বদলে বদলে যায় …আমি অবাক হই এই ভেবে আমার সব কবিতা বই মিলে ছাব্বিশ ফর্মার মতো …অথচ আমার প্রথম কবিতার বই বেরোয় কবিতা চর্চার তের বছর পর ,২০০৫এ
আমার লেখা লিখির ক্ষেত্রে শব্দ -ভাবনার একটা অন্তর্গত ভূমিকা আছে ,তার দৃশ্য শ্রাব্য গুণের …আমি এক সময় নিজের আইডেনটিটি,র জন্য প্রচন্ড বেপরোয়া ভূমিকা নিয়েছি কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে …তুমি যদি আসো কখনো তাহলে দেখাতে পারি অন্তত দশ বারোটা ডায়রি ,যেখানে অজস্র হাটে মাঠে বাঠে ব্যবহৃত শব্দর পাশে অজস্র নতুন শব্দ আমি বানিয়েছি এবং নিজের মতোন করে তাদের প্রয়োগ করেছি …শব্দের অ্যাপিয়ারেন্স ও রিয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন খুঁজেছি …শব্দের শূন্যতা ও sound of the absurd নিয়ে …নিসর্গ ও বিভিন্ন রঙ-এর সম্পর্ক তার স্তর ও self -alienated মানুষের স্বপ্ন …অবভাসিক জগত্ নিয়ে study করেছি দিনের পর দিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
: সম্পর্কের বস্তু গুণ কে আরোপ করেছি সমস্ত চলমান জীব ও জড়ের অভেদ কল্পে গিয়ে …ভেবেছি পাখিদের ইকো -ফেমিনিজম নিয়ে …!তার অনুষঙ্গ -অনপেক্ষতা …অ্যাবসোলিউট বা আত্যন্তিকতার সমতুল ডেকে ওঠা কি নিছক না উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ?কি কৌশল আছে নিসর্গ -রাজনীতিতে ?কি ?
এভাবেই উত্তর গঠনবাদের কেন্দ্র ও প্রান্তের সংঘাত নিয়ে পড়েছি ,আর ধীরে ধীরে অনুভব করেছি ,মানুষ নামক আপাত সভ্য শাসকের চাতুর্যে অতিষ্ট হয়ে প্রতিষ্ঠানিক খাঁচা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে কি ভাবে বিকল্প বোধের সম্ভাবনা
: আমার কবিতার চলাচল কাঙ্খা  তার জবানি ন্যুভেলভাগ তার কোরাস -সাইকো -অ্যানালাইসিস সব কিছু সব ,অনুভূতি প্রদেশের আশরীর দ্বন্দ্ব ও ক্রমিক ব্যাপ্তিতে একাগ্র শব্দ আশ্লেষ -এ পাগলের মতো খুঁজে গেছে ওই সেই বিরাট মহা পৃথিবীর ক্যানভাসটাকেই শেষ পর্য্যন্ত …পেরেছে কি কিছু …জানি না জানি না গো …
তবে আবার একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে আছি …পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্চ একটু একটু …কিছু লেখা নিয়ে ,নতুন কবিতার একটা বই হতে পারে আর কি ,এ বছরের august -সেপ্টেম্বর নাগাদ বেরোবে …নতুন বই ,আমার আগের বই এর তুলনায় অন্য কিছু বলবে কি না …সেটা তোমারই জানিও …
(তোমরাই জানিও হবে )এ কথা সে কথা বলতে বলতে আমার হঠাত্ মনে পড়ে jacche আমার একটা কবিতা …সুফি রং বইটায় ছিলো ….
: পাখি বাজছে পুরনো বাঁধা
: জানলার আস্তিনে জল নয় ,
ছায়া নয়
পাখির দেহস্থিত
: খুঁটিনাটি বৃষ্টি আর
: একই অবিকল্প ওড়া ,তবু এতো বিকশিত বিভিন্ন স্ফুরণ
: এতো গন্ধের ভিন্নতা …
: এই তো …আর কী….!
অনিন্দ্য: ভালবাসা,  বন্ধু । তোমার কবিতা,  তোমার মননশীল গদ্য আমাদের আরও আরও মুগ্ধ করুক
প্রদীপ: তোমাকে তোমাদের কবিতাডিহি কে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাই …তোমরা যে ভাবে আমার লেখার পাশে থেকেছো,তাতে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই ..খুব ভালো থেকো …কবিতাডিহি নতুন ও স্বাধীন ভাবে লেখা লিখি করতে চাওয়া কবিদের একটা আশ্রয় হয়ে উঠছে ,এটা একটা বড়ো পাওয়া আমাদের …

সন্দীপ রায়

সন্দীপ রায়

 ট্রমা

              ১

অথচ বার বার তার পারফিউম চিনে যাই

ড্রয়ারে রাখলে আবার বেরিয়ে আসে
পুরানো ক্ষতটা মলমের ঢেকুর তুলে
তবু সারতে চাইছে না,
কিন্তু স্বপ্নের ভিতর এফোঁড়ওফোঁড়
চলে যাচ্ছে চিরুনি।

       আমি চিরুনি তল্লাশির ৈসনিক
খুঁজছি    –   তোমায়
শিকড়ে
আরোগ্যের ডগায়
তুমি পাচ্ছি না
শুধু চেনা পারফিউম বাতাসে ঘুরছে

             ২

পড়ার টেবিলে বসানোর আরাধ্য পাচ্ছি না
লেখার অন্তিম চরণে ঈশ্বরের
অনুপ্রেরণা পাচ্ছি না

আসলে গাড়িটি  হুইসেল মেরে
ঢুকে  গেছে  যে  টানেলে
তার  কাছেই   হাটুজলে ভেঙেছে
দেবতার ছায়া।

সময় শুরু হয় নাকি শেষ
কোনো ধানসিঁড়ি  বলে নি

      ৩

ঘটনাটা চেতলার ও হতে পারে কিম্বা চিনা বাজারের
ফেরত চাইলে প্রতিশ্রুতিহীন লেভেল ক্রসিং!

দাঁত কিড়মিড় করে – ট্রেন চলে গেলে
সাইরেন শোনা যায়,
সবুজ পতাকা থাকে না প্রহরী বিহীন

অসহমতের সহবাসে যে যে শর্ত থাকে
তাতে চিল শকুন মরা মাংস খায়

                 ৪

সারমেয় কথা পার্লামেন্টে ঢেউ তাই
অথচ খিস্তিতে দাঁতে দাঁত ঘসা খেয়ে যায়

                   ৫

সারকামস টেন্সিয়াল  এভিডেন্সের উপর বিচার করলে
তোমাকেই খুনি বলে ভাবি।
ড্রয়ারে ভরা ঘাম আর হলুদ কাহিনী

এমনি তেই আততায়ী চন্দ্রালোক
জোছনা খেয়ে বৈরাগ্য এসেছে

ঠাকুর ঘরে কোন কলার গায়ে
তার নাম লেখা থাকে?

ফ্লেমিংঙো নয়  আর স্ট্রবেরীও
জাফরানি রঙ শুধু রক্তের চিকচিক

সেঁকা রুটির মতো সুষুম্না খেয়েছে সকলে
সারকামস টেন্সিয়াল এভিডেন্স
তোমাকেই ভাবিয়েছে খুনি!

                  ৬

দুঃসহ মেয়েটির গা থেকে উল্কা,  নক্ষত্র
ধুমকেতু উড়ছে।  মেয়েটি তার  স্বভাবসিদ্ধ
ভঙ্গিতে  মাছি তাড়াতেই ব্যস্ত।  দিনান্তে
তার গোনা হচ্ছেই না  এক্কাদোক্কা স্কোয়ার

বিগত কয়েকটি দুর্ঘটনাজনিত
ট্রমা গাছের কোটর থেকে ছিটকে গেলে
রাজপথ আর সওয়ারী
সমবেদনায়  উলটে দিচ্ছে থলি

অপারেশন থিয়েটার

এক প্রান্ত প্রদেশে সকলেই চলে যাচ্ছে
কখনো তর্জনী      কখনো মধ্যমা  দেখিয়ে
চলে  যাচ্ছে

আমি ছোক ছোক করছি  –  কিছু কি হয়েছে ?
কোথাও কি চুরি যাচ্ছে  কৌতূহল ?
আমি ঘোত ঘোত  করছি?
আমার নাক  কি শুকর শুকর?
শব্দ  তরঙ্গ এ পিষে যাচ্ছে নৈশব্দ
এবং এক শব্দের ভিতরেই আরেকটি জন্মাচ্ছে
আমি কবিদের দেখছি

      এক আশ্চর্য  আস্তরণ  বিছানো
আমি দেখছি বুদ্ধির পলতে
পাক    পাক    পাক

আমি পলতে তে আগুন ধরাতে পারছি না

সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে গিয়ে দেখছি
আমি পিছিয়েই গেছি
অসহমত ব্যাপ্ত হচ্ছে
মিশে যেতে পারছি না আমি
অথচ।

দেখছি পায়ের ধাক্কায়  সিঁড়িটা  কেঁপে উঠছে বারবার

আক্রান্ত বরষা দিনেই কথাই শুধু লিখে যাই
আক্রান্ত কুয়াশা ভোরের কথাই শুধু লিখে যাই

লতলতে কাঁধ রেলগেট পেরোবে এখন
সোজা পথ ধরে সব হাঁটাতেই
বিভ্রমের আগাছা থাকে

আমার শরীর থেকে খুলে নাও সব নম্বর, অরণ্য, জনপদ

বিশ্রামের চৌকাঠ  ডিঙোতে দাও

কোন অবসাদ বিকালে ডুকে পড়েছি  ঘোড়া দোড়ের মাঠে
গোটানো আস্তিনে জকিদের খিস্তি গুজে রেখে
সবুজ ঘাসে ছুটে মরছে  পরকীয়া

ইশারায় ছড়িয়েছে  রিউমার  তরলের মতো
মেডিক্যালে চলছে এনাটমি

তর্কে জমজমাট সো থেকে ধ্রুপদ ছড়াচ্ছে

শাঁওলি দে

শাঁওলি দে
আলো অন্ধকারের কবিতা
অন্ধকার থেকে একটা কালো হাত
বেরিয়ে এল হঠাৎ
আমি চমকে উঠলাম
টেনে বের করে আনলাম আমার অস্তিত্ব।
সব অন্ধকারে ডুবে যেতে নেই
কিছুটা আগুন জ্বালানো ভালো
দাউ দাউ আগুনের ভেতর
      এক অনাবিল প্রশান্তি
অদ্ভুত সহাবস্থান!
    চোখের জলে পরজন্মের উৎসব সাজাই
ভালো থাকি তাই
      ধেয়ে যাই আলোর দিকে
একটু হাঁটলেই প্রবল জলোচ্ছ্বাস
তবু তুমি আবেগহীন বলবে?
শব্দগুলো কখনোই পারিনি ঠিকমতো সাজাতে
তবু চেষ্টার ত্রুটি ছিল না , তুমি জানো!
নিজেকে কখনো নির্বাচিত কবিতা সংকলন মনে করিনি
তাই একা থেকে গেছি
   বারবার সাক্ষী থেকেছি
অসংখ্য সুনামীর।
রেললাইনের ধারে যে লোকটা
মুলি বাঁশের বেড়া বিক্রি করত
তার বউ’এর পাল্টানোর শাড়ি নেই একটাও
অথচ লোকটি সবাইকে আড়াল দিয়ে বেড়ায়
চাল আর শাক ফুটিয়ে খেতে খেতে
ওরা একদিন ভাতের গন্ধ ভুলে যায়
চোখের জল দিয়ে নুনের খরচ কমায়।
লোকটির মুলি বাঁশের বেড়া বিক্রি হয় না
লোকটির বাড়ির ছাদ দেওয়াল
একে একে সরে যেতে থাকে
ওরা আকাশে ঘর বাঁধে।
ঘুম ফেরি করত সে।
প্রতিদিন দেখতাম ওকে
        আপ বা ডাউনে
আমার কোনদিন ওকে ডাকবার
প্রয়োজন হয়নি
 তারপর হঠাৎই রাস্তাটা বদলে গেল . . .
ফিরে এসে অনেক খুঁজেছি ওকে
শুনেছি . . .ও নাকি নিজেই ঘুম কিনে নিয়েছিল মুঠোভরে
অথচ আজ আমার যে ওকে বড্ড দরকার
হয়ত একদিন বা তারপরের দিন
সময়টা আসলে কোনো বাধাই না
এক একটা দিন হুট করে বেরিয়ে যায় মুঠো থেকে
কোনো কোনো দিন যেন এক যুগ
‘শুভ রাত্রি’ বলার পরও কি সব রাত শুভ থাকে?
          না থাকা উচিৎ!
অথচ এই শুভ অশুভ’র মাঝেই দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি দেখো
      যে কাল আমার চলে যাওয়ার কাল
     তাকে ঠেকায় সাধ্য কার?
হারিয়ে যাওয়া শৈশব . . .আজও
কখনো কখনো তাড়া করে বেড়ায়
 পশ্চিমে লাল হয়ে যাওয়া আকাশে যখন
       পাখি দল বেঁধে ফেরে ঘরের দিকে
     মা তখন তুলসী মঞ্চে
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত
গুনগুন নামতা বা ভৌগলিক ব্যাখ্যার ফাঁকে
শঙ্খধ্বনি
     আজ আর কোথায়?
বারো ঘর এক উঠানের সেই হইহই আমেজ
  আজ হাক্লান্ত।অতীত।
তবু কিছুই কি নেই?
তবে কেন আজও অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে
       গলার কাছে আটকে থাকে
   হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির কষ্ট
ব্যস্ততম দিনেও অজান্তেই
চোখ ভরে যায় জলে
    কিছু তো আছেই আজও অবশিষ্ট
      তাই তো এখনও অবলীলায় বলে উঠতে পারি ‘ভালোবাসি’
এই পথের শেষ নেই কোথাও
   যতটা সরলরেখা বরাবর গেলে
        একটা রাত ফুরোয়
ঠিক ততটুকুই আমার চেনা
    চেনা স্রোতে ভাসানের গান গাই
 হে অনন্ত,দু’হাত ভরে জমিয়ে রাখা কালো’কে রাত নাম দিলে ?
পথের শেষ দেখাতে পারলে না!
শ্বাস রোধ করে বেঁচে থাকি
      মৃতদেহের মত
যে রাত রোজ পুড়ছে
         তাকে আর ভয় কি?
ঘুরতে ঘুরতে,চলতে চলতে
আমার তোর কাছেই ফিরে আসি
 এই যে সম থেকে সমে ফেরা. . .
     একেই জীবন বলে জানি।
  গুমরে থাকা মনটা হঠাৎই গেয়ে ওঠে
  “তুই জীবন ছাইড়া গেলে
মাইনসে কবে মরা জীবন রে!”
১০
পুড়ছে যা কিছু সেসবের
ছাই ওড়ে না কোথাও
যে নদীতে জল থইথই বারোমাস
তাতেই ভয় নৌকাডুবির
জল,আগুন সবই নিয়ম মেনে চলে
আমি শুধু পুড়ে যেতে ভয় পাই
আমি শুধু ডুবে যেতে ভয় পাই।

সৌম্যদীপ রায়

সৌম্যদীপ রায়

আলো বিষয়ক টিকাগুচ্ছ


আলো নিয়ে প্রথম পড়াশুনো করার
অনেক আগেই আমি আলো বিষয়ক অনেক কিছুই জানতাম।
ঠিক যেমন সদ্যোজাতর প্রথম কান্নায় একটা ‘মা’ ডাক লুকিয়ে থাকে,
ঠিক সেভাবেই আলোর কোনো সমীকরণ না জেনেই
আমি জন্ম থেকেই দেখতে পারতাম

কখন সকাল হচ্ছে, কখন সন্ধ্যা  ঘনিয়ে আসছে আর

কখন আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে

একটু চুলের বিন্যাস ঠিক করে নেওয়া দরকার।

আলো এক ধরনের শক্তি মেনে নিলেও
সেই বিষক্রিয়া যে আমার চোখে প্রবেশ করলেই
আমি সব কিছু দেখতে পারবো তার কোনো মানে নেই।
আলো একটা বস্তুকে দৃশ্যমান করে তোলে ঠিকই
কিন্তু সেই বস্তুটি সাত রঙের মধ্যে কোন রঙ শুষে নিচ্ছে
সেটা জেনে নিতে হলে, তার বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান খোঁজ নিয়ে জেনে নেওয়া ভালো।

এই সতর্কীকরণের একটাই কারণ সেটা না জানা থাকলে সেই আ-লৌকিক শক্তির কাছে হার মেনে সারাজীবন একটা সাদা ঘোলাটে রঙ চোখে আসতে বাধ্য।

আমরা আলো দেখতে পাইনা।
আমরা আসলে আলোকিত বস্তুটাকেই শুধু দেখতে পাই

আর খুশি থাকার চেষ্টা করতে থাকি অনবরত।
আলো না থাকলে দুঃখপ্রকাশ করি, হা-হুতাশ করি, ডেকে উঠি
“অন্ধকার” “অন্ধকার”।
আমরা আসলে এক বিধবার মতই বেঁচে আছি।
ফুলের মালা থেকে আলোকিত হওয়া

ছেলের বা মেয়ের মুখ দেখেই অনেকে আলোকে অনুভব করে।

আলো এক ধরনের তরঙ্গ।
অনেকে তরঙ্গ বোঝাতে এক বালতি জলের মধ্যে একফোঁটা  জল ফেলে

ঢেউ-এর উদাহরণ দিয়ে থাকে।
আমি তাদের জিজ্ঞাস করিনি সমুদ্রের ঢেউএর সঙ্গে এটার পার্থক্য কী।

আমি জানি সমদ্রের ঢেউএর সঙ্গে চাঁদের একটা সম্পর্ক আছে।
আমি নিজে সেটা জানলেও অনেকেই সেটা জানেনা,

তাই জীবনে নিজের চোখে দেখতে শেখার সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক অনেকেই মেনে নেয়না।

আলোর গতিবেগ মাধ্যমের ঘনত্বের ব্যস্তানুপাতিক।

আবার এটাও জানা গিয়েছে শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ সব চেয়ে বেশি।

এটা মেনে নেওয়ার পর থেকেই

আমি সকাল সকাল উঠে বাড়ির ছাদে পৌঁছে

আকাশের শূন্যতায় চিৎকার করে বলি “আমি খুব ভালো আছি”,

আর এরকম করে আমি সত্যি খুব ভালো থাকি।

আমার সেই ভালো থাকায় অন্য কোনো মানুষের মন-মেজাজের ঘনত্বের প্রভাব পড়েনা।

সাদা আলো সাতটি রঙের মিশ্রণ আর

প্রিজম ব্যবহার করলে সাদা আলোকে

সেই সাত বিভিন্ন রঙে আলাদা করা যায়।

ঠিক এভাবেই সপ্তাহের সাত দিনে আমি কী কী করলাম

বা কী করতে পারলে কী ভালো হত

যখন বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি

বুঝতে পারি চাওয়া পাওয়ার হিসেব করা একদমই অনুচিত।

এই জন্যই আমি বাড়িতে একটাও প্রিজম রাখিনি।

আলোর বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রতিফলন।

ঠিক যেমন আমি নিজের মনে, নিজের মত চিন্তা করতে করতে কিছু একটা নির্নয় করলাম আর সেটা অন্য ব্যক্তিকে বললাম, যে ব্যক্তিটির নিজেরও একটা ভাবনা-চিন্তা আছে, নিজের জগত আছে, সে একশ শতাংশ আমার কথা মেনে নেবে না।

আমি আর সেই ব্যক্তিটি আসলে দুজন দুটো মাধ্যম আর আমাদের মত বিনিময় একটা বিভেদতল।

আমার নিজস্ব যতটুকু প্রকাশিত ভাবনা সে ব্যক্তিটির মুখের না-মেনে-নেওয়া ভাব ভঙ্গী থেকে ঠিকরে ফিরে আসবে সেই ঘটনাকেই আমি প্রতিফলন না দিয়েছি।

৭ নম্বর উদাহরণেই যদি ধরে নিই অপর মানুষটি নিজস্ব কিছু সঙ্কটের মুহূর্ত দিয়ে যাচ্ছেন, আর সেই সন্ধিক্ষণে আমি কিছু আলোর রশ্মি ফেললাম দুজনের বিভিন্ন মানসিক ঘনত্বের বিভেদতলে , তাহলে কিছুটা হলেও অল্প কিছু কথা তার ভালো লাগবে আর পৌঁছে যাবে সেই মানুষটির মনের গহ্বরে। আমার বলে দেওয়া ভালোবাসার কথা অল্প হলেও দিক পরিবর্তন করতে বাধ্য দুজনেরই। এই অনুভূতিটাকেই আমরা আলোর প্রতিসরণ বা নতুন ভাবে ভালোবাসায় নিজেকে বদলে নেওয়ার সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

প্রতিসরনের সূত্রে দুটো মানুষের কথা বারবার ওঠে।

মূলত সেই দুটো মানুষের মানসিক ও শারীরিক ঘনত্বের পার্থক্যের জন্যই সমাজ এই বিশেষ সূত্রটির উল্লেখ করেছে। প্রথম ব্যক্তি যে কথাগুলো বলে তাকে আপতিত ভাবনা ও অপর ব্যক্তি কিভাবে ও কতটা সেই কথাগুলো মেনে নেয় তাকে প্রতিসৃত ভাবনা বললে, আমার এটা বুলে গেলে চলবে না যে আপাতন কোণ ও প্রতিসরণ কোণের উপর ভালবাসার দীর্ঘস্থায়ীত্বতা নির্ভর করবে।

১০

আপনি যখন মন খারাপের রাজত্বে নিজেকে রাজা ভাবছেন আর আপনার ভাবনা চিন্তার ঘনত্ব আপনার মনের মধ্যে বাসা বেঁধে দিন দিন সুন্দরবনের ঘন ম্যানগ্রোভের মত দানা বাঁধছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার চিন্তাধারার তরঙ্গ থেকে যে আলোকরশ্মি পারিপার্শ্বিক আধুনিক সমাজের কোনো নির্জিবের উপর আপতিত হল তখন অনেক কিছুই হতে পারে। সেই অপর মানুষটির নিজের মানসিক সঙ্কট কোণের থেকে অনেক বেশি হয়ে আপতিত হলে আপনার ভাবনা চিন্তা পুনরায় আপনার কাছেই ফিরে আসবে। তখন আপনার নিজের বদলে যাওয়া অবস্থানের ঠিকানা পূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের সূত্রে পাওয়া যাবে।

সৈকত ঘোষ

সৈকত ঘোষ

সিগমা চলন

১.
যে রোদ আমাকে সিলভারস্ক্রিন দেখিয়েছে
তার ঠোঁটে সাফল্যের চিহ্ন আঁকা হোক
ঝড়ের স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে অবসর বিনিময়

আমি দায়িত্বশীল কাটাকুটি পথে
নিজেকে চিড়েছি বারবার

ডিসেকশন টেবিল জানে শিরোনামে উঠে আসার রেসিপি

২.
খুশবুদার জীবনে ফ্লেভার এনেছে
পাউচ খোলা হাঁ-মুখ

আমি শবনমকে চিনি
তার অশ্বক্ষুরাকৃতি হাসি
ঘুমের শরীরে মাখিয়ে দিয়েছে নারকোটিক সুখ

এ পর্যন্ত গল্পটা চেনা
গতিপথ বদলালে কানামাছি ভোঁ ভোঁ…

৩.
ঠিক সময়ে আঁচল খসে পড়লে
কেঁপে ওঠে এপিসেন্টার

চোখে চোখ সেই মেক্সিকান তরুণী

আমার প্রিয় বাইশগজ
ডায়েরি পেন
এত দিনের অভ্যেস
বয়াম ভর্তি নিস্পলক

এসো থার্মোমিটার কৌতূহলী হও

৪.
ভিজছি ভিজছি এবং আরও ভিজছি

তোমার শরীরে ভাঙা শব্দের কোলাজ
অপেক্ষার বনসাই সবটুকু নিরাময় করে দেবে

সামনে তাকাও, সিগন্যাল টকটকে লাল

৫.
সম্পর্কের কোলাজে লুকিয়ে রাখি
আনালজেসিক চিহ্ন

আমি বারবার আত্মগোপন করি

তোমার শরীরে বিপ্লবের স্ফিংটার

৬.
দিন-ক্ষন মেনে হয়ে ওঠেনি
ছাইদানি পুড়ে গ্যাছে ভুলে
আমি ভুলের মাশুল গুনতে গুনতে
আরও বেশি করে ট্রান্সপারেন্ট হয়েছি

বায়োমেট্রিক শহর জানে
কতখানি অক্ষমতা ঠিকরে বেরোলে
জ্বলে ওঠে আলো

৭.
এভাবে একমাত্র সময়ই বোঝাতে পারে

শেষ বল খেলতে নামার আগে
অনুভব করেছি

ডানাকাটা পরি নয়,
বাস্তবের সেই চুপচাপ খুব সাধারণ মেয়েটি
কিভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠে

৮.
খিদের কোনও ডায়মেনশন হয় না
কোনও মিউচুয়াল বন্ধু নেই খিদের

আমি বারবার কলিংবেলে হাত রেখেছি

ভাঙতে ভাঙতে একসময় সমস্ত পরমাণু
অবিশাস্য গতিতে পৌঁছে যাবে স্বর্গের
আপেলবাগানে

পরের জন্মে আমি হেগে ডলারে মুছবো

৯.
যতই সময়কে দোষ দাও
সময় কিন্তু চিয়ার লিডার নয়

আমি সময়ের চোখে ডিটেক্টর দিয়ে দেখেছি
সে জানে কার থেকে কতটা ক্ষীর খেতে হয়

তার চেয়ে মেপে দেখো:
যে সবচেয়ে বেশি দুঃখ দিতে পারে
হতে পারে সেই তোমার ট্রামকার্ড…

১০.
যতবার গুছাতে গ্যাছি ততো হারিয়েছি সবকিছু
ভেঙেছে সম্পর্কের আকোরিয়াম

আমিও খাবি খাচ্ছি, কোথায় এসে দাঁড়াবো
মাঝরাস্তায় ভ্যানিশ হয়ে গ্যাছে রাস্তাটা

ভেঙে যাওয়া পিক্সেল জোড়া দিতে দিতে বুঝি
সব শেষ ট্রেন কেন ঘরে ফেরেনা