রাজীব দত্ত

উৎসব

ভেতর ঘরে আজ আমার অতিথি আসবে
ও শিমুল তুমি একটু রঙ ঢেলে দাও
রজনীগন্ধাকে বোলো ও যেন সুরভি দিয়ে যায়
আমি যাচ্ছি ঝরনার কাছে। ও কেন এখনও জলধ্বনী
নিয়ে এলো না ঘরে। হাওয়ার পাখিগুলোকে
ঠিকঠাক আসতে দিও জানালা দিয়ে। আয়োজন পূর্ণ কর।
ভেতর ঘরে আজ আমার অতিথি আসবে।
ওকে যে দিতে হবে আলোর আপ্যায়ন


কামিনী


কামিনী গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছি
দুল দুল ঝরে পরছে ফুল।
তুমি তো পূব গাঁয়ের মেয়ে
আলো ছড়াতে ছড়াতে এলে আর
বৈরাগী-বিকেল রেখে গেলে চলে।
এখন কি কুড়ায়? মূঢ়-বধীর-রিপুতাড়িত আমি
কামিনী গাছের তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি
কামনার আসা-যাওয়া


এই ঘোর, এই যন্ত্রণা


দুপুর ক্লান্তি, ঘুম আমাকে টানে। টেনে নিয়ে যায়
সাটার নামানো রাতে, ছুতোরের রাঁদায়
এখন আমার ঘোর। আমি শব্দ বীজ খুঁটি।
পোস্ট অফিস ঘুরি। বর্ষার বাঁশবনে ছত্রাক হয়ে ভিজি।
তুমি কি এক্ষুণি আমাকে ডাকবে, বলবে:
এই নাও চা, এই নাও- ব্রণমুখ, হলুদ শাড়ি।
বোকা মানুষেরা বিদেশ পালাতে গিয়ে কতবার কেঁদেছিল
বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তুমি কি সেই কথাও
আমাকে শোনাবে


ফুল

দূরে যেতে যেতে আরও দূরে
চলে যাও যদি
যদি, আরও একটি বার ফিরে তাকাও
তাহলে দেখবে
দেখবে তাহলে
কাল রাতের তোমার সেই দস্যু
প্রভাতের ফুল হয়ে ঝরে গেছে
বাংলার পথে পথে...


বৃক্ষের নিকট প্রার্থনা

আমাকে মগ্ন কর দাও স্থিরতা
আমাকে ব্যপ্ত কর দাও শীতলতা
আমারো অর্ধেক মাতৃমৃত্তিকায় আবিষ্ট হোক,
অর্ধেক বিকশিত আলোর সংসারে।
আমাকে অশান্ত কর, হে বৃক্ষ হে মহিরূহ
আমারও হোক জয়হীন পরাজয়হীন
পুষ্পের প্রস্ফুটন।

রোদ্রু

বৃষ্টি শেষে রোদ পড়েছে
টালির চালে।
চড়ুইয়েরা খেলছে সেখানে।
ওরা খেলছে আর আমাকে বলছে:
দ্যাখো দ্যাখো, এদিকে তাকাও।
কাঁঠাল পাতার আড়াল সরিয়ে দেখি
সজনে ফুল কুড়ানো বালিকার মতো
আজ রোদ্রু ঝুঁকে পড়ছে
আমাদের উপর।

ঘর

বাইরে থেকে কত চুপচাপ
দরোজা খুললেই
চিৎকার করে ওঠে সারাটা ঘর
দরোজা বন্ধ করলেও তাই
জলের গ্লাস ফেললে কিমবা
সিঁড়িতে পা- প্রতিটি ক্ষণেই
ঘর বলে ওঠে: আমায় ফেলে
কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

বাইরে থাকলেই কত চুপচাপ

ভেতরে গেলেই কত কোলাহল। কত প্রতিধ্বনি।
কত কত অভিমান।

জলছাপ

শুধু শুধু তোমার সঙ্গ চেয়েছিলাম
বরং আরও আগে বেড়িয়ে পড়লেই ভালো হত। ওই তো
একটা লাল শালুক এখনও কিছুটা ফুটে আছে।
মাছেরা গা ঘষছে ওর ডাঁটায়। আর একটা মেয়ে
টুপ করে ডুব দিয়ে চলে গেল।
কোথায় গেল ওই মেয়ে-
জলছাপ ফেলে ফেলে, কোথায় গেল?



নদী

ঘুরে ফিরে সেই তো আবার নদীর কাছেই ফিরে এলাম।
এখন যদি ঐ লকগেট ভেঙ্গে যায়, জলের তোড় আমাদেরকে
ভাসিয়ে নিয়ে যায়- কেমন হবে তখন আমদের সুখ।
ওই আবছা ছায়রঙা আমাদের বাসর ঘর, ধানের গোলা,
ফুলের বাগান
ওই কারা যেন গ্রহণ করল ওসব। আপন করল।
এসো, ওদেরকে দূর থেকে আশীর্বাদ করি। নদীকে বলি:
বন্ধু, ভালো আছো


প্রতিমা

কেন যে ওরা বারবার ফিরে আসে,
বারবার দুঃখের গান শোনায়!
আমিও কখন নদীর কথা ভাবতে থাকি
এক সময়, আমিও নিজে নদী হয়ে যাই। বইতে থাকি
শ্মশান, জেলেবস্তি, ভুট্টাখেতের পাশ দিয়ে
আমারও জলে তখন প্রতিমার নিরঞ্জন হয়


 ঢেউ

কথা ছিল নদীর উৎসমুখে
দেখা হবে তোমার সাথে। কথা ছিল। তবুও
যায় যায় করে তুমিও এলে না।
যাই যাই করে আমারও যাওয়া হল না আর
না জানি কত জল উৎসমুখ থেকে
বয়ে গেল সাগরের দিকে
অশ্রুর মতো সেইসব আশ্চর্য জল
ঢেউ হয়ে ফিরে এল
আমাদের চরাচরে...

…উঠানতারে

উঠানতারে কাপড় মেলতে আসোনি তো আজ
এই দগ্ধ দুপুর, আইসক্রিমের ভ্যান, কালো পিঁপড়ে
সাপের পিঠে শুধু ছুটে আসে।
ছোবল ছোবল খেলা অত সহজ নয়, যদি, ক্ষিপ্রতার সাথে
দক্ষতা না থাকে

উঠানতারে কাপড় মেলতে আসোনি তো আজ

ডাঁশেদের গান বারোয়ারী কল, থালা ধোয়ার শব্দ
একবার আমাকে বলেছিল- পালাও, পালাও এখান থেকে।
পালিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি আমার
পালিয়ে কোথায় যাব যদি না উঠান তারে
তুমি রোজ কাপড় মেলতে আসো
স্নানের শেষে...

ছোটো মানুষের গান

হাওয়া মেঘ জলপ্রপাত পেরিয়ে
এ তুমি কোন দেশে এলে!
তোমার রাত কাঁদছে দিন কাঁদছে
তুমি ভাসতে চাইছ। বদনাম চাইছ।
পাতলা ছোটো ছোটো ঢেউয়ে
নুড়ি ও কাঁকড়ের দলে
মিশে যেতে চাইছ।

হাওয়া মেঘ জলপ্রপাত ভুলে
এ তুমি কোন দেশে এলে


দুখিগান 

সমস্ত বিকেল তুমি বাড়ির বাইরে গেলে না
প্রিয় রাত্রিকেও দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিলে।
তুমি কি আজ হিমের পতন দেখবে না,
রাতপাখির দুখিগান শুনবে না?
তবে, কি করে আজ পিয়ানো বাজাবে তুমি,
আমি কি করে আজ তোমার কাছে আসব?
সমস্ত ঘর-দুয়ার নদী হয়ে দুলছে। তুমি ভাসছ।
আমি কতক্ষণ আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকব?

পানসি

কোন কথা না বলেই তুমি চলে গেলে
যেতে যেতে শরবনে আগুন ধরিয়ে দিলে
কি আকাশ ভেঙ্গেছি বলো, কেন চোখে ভরা কটালের জল?
জলে জলে জল থৈ থৈ তোমার ঘর
তুমি দাঁড়াও। পানসি নিয়ে আমিই আসছি আজ
তোমার কাছে।

বকুল ফুল

শালুক বনে আজ আবার বৃষ্টি জেগেছে
তোমারও চোখে টলমল জল
আজ কি তবে আমারও ভাসান হবে-
ভাসান হবে ওই কুনূরে?
খিড়কি-দুয়ার খুলে তাই কি তুমি
চুপি চুপি চলে গেলে,
অভিমান ছড়িয়ে দিলে বকুলের ফুলে।

উড়োজাহাজ

এই যে আমি আর কিছু নই
কাগজের উড়োজাহাজ।
উড়তে উড়তে শেষে
এসে ঠিকেছি তোমার পায়ে।
তুমি কি একে আলতো হাতে তুলবে না?
উড়িয়ে দেবে না
সীমাহীন মহাজাগতিকে!

নূপুর

যদি এ আসা সরলতার কথা বলে
তবে স্পর্শ হোক তোমার অগোছালো পায়ের ছোঁয়া
ওগো আলতা রাঙা মেয়ে, দেখো, তোমার জন্য নূপুর এনেছি
তুমি কি আজ উঠানময় আমার জন্য নাচবে না...


গরল

যে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল একদিন
তুমি তাঁর কথা শুনলে না
আকাশকে তুমি ঘর বললে। দূর... নীল...
আকাশের দিকে তুমি উড়ে গেলে।

নীল... নীল...

গরল ছড়িয়ে যাচ্ছে আজ তোমার
ডানার প্রতিটি পালকে...

পালক

যে শ্বেতশুভ্র পালক এক্ষুণি ঝরে গেল
উড়ল না আর পাখিটির সাথে
তাকে তুমি বিফল ভেবে
ভুলে যেতে পারো।
তবুও জেনো, কোন এক অবাধ্য গ্রামীণ বালক
কোন একদিন তাকে তুলে নেবে
ধুলোর পৃথিবী থেকে।

সেইদিন, হয়তো সেইদিন সেই পালকের নিজস্ব উড়ান কাহিনী
গান হয়ে ভেসে যাবে
পৃথিবীর বুকে...

সামখোল বক

এবার হাওয়ায় কি কেউ শুনেছিলে প্রিয়জনের খবর?
যে কাজের মেয়ে ঝাঁট দিতে ঢুকেছিল ঘরে
সে আমার রেডিও নিয়ে
পালিয়েছে মাঠে।
কেউ কি দেখেছ তাকে?-
আমি শুধু দেখেছি তার তুলসীতলার ধূপ।
‘সাঁঝবাতি কে দেবে এখন’?-
পুরনো রেডিও থেকে
এমনই গান কি ভেসে আসে
বালির প্রদেশে?
সামখোল বক হয়তো এ খবর
রেখেছে শুধু

 

….